চলতি বাণিজ্যের পর্ব ২২
চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান
‘চলতি বাণিজ্য’
চলতি বাণিজ্যের ২২তম পর্বে থাকছে:
১. আধুনিক সিল্ক রোড তৈরি করবে চীন ও সৌদি আরব
২. চীনে দুই অংকের ব্যবসা প্রবৃদ্ধি অর্জনে মরিয়া ক্রাফ্ট হাইন্জ
৩. মিশরে কারখানা স্থাপন করছে হায়ার
আধুনিক সিল্ক রোড তৈরি করবে চীন ও সৌদি আরব
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: অর্থনীতির বহুমূখীকরণ ও তরুণদের নানা ক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আরব দেশ ও চীনের মধ্যে আধুনিক ‘সিল্ক রোড’ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরবের বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়। চীন ও আরব বিশ্বের মধ্যকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে সম্প্রতি শেষ হওয়া ১০ম আরব-চায়না বিজনেস কনফারেন্স। সৌদি আরবের রিয়াদে সম্প্রতি শেষ হওয়া ২ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে কেবল এই দুই দেশ নয় বরং আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও চীনা ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সম্মেলনে দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত ৭০ বিলিয়ন ইউয়ান সমমূল্যের ৩০টি সহযোগিতা চুক্তি সই হয়েছে।
সম্প্রতি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অনুষ্ঠিত হয় ১০ম আরব-চীন বিজনেস কনফারেন্স। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সৌদি আরব ও চীনের মধ্যকার বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানো। তবে পুরো সম্মেলনে অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিলো চীনের প্রস্তাব করা বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সৌদি আরবের অংশগ্রহণ। কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ করে সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মধ্যে আকাঙ্ক্ষার অনেক জায়গায় মিল আছে।
২০০৫ সাল থেকে শুরু হলেও চলতি বছরের এই সম্মেলনের অন্যতম দিক ছিলো উভয় দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক, প্রায় ৩ হাজার প্রতিনিধির অংশগ্রহণ। উভয় পক্ষের মধ্যে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ৩০ টি চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়। এসব চুক্তি ও সমঝোতা বাস্তবায়নে এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করা হবে ৭০ বিলিয়ন ইউয়ান। সহযোগিতা বাড়বে জ্বালানী ও খনিশিল্প, সরবরাহ চেইনের উন্নয়ন, পর্যটন ও স্বাস্থ্যসেবাখাতে। এসব চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে চীনা বিনিয়োগকারী এবং বিজিআই জেনোমিক্স কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইন ইয়ে বলছেন, আরব বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত হলো।
ইন ইয়ে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিজিআই জেনোমিক্স কোম্পানি লিমিটেড
আমরা মনে করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারাও আমাদের মেধাস্বত্ত্বকে স্বীকার করে নিয়ে এখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করতে স্বাগত জানিয়েছে।
সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চাওয়ার নানা কারণের মধ্যে আছে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির বহুমূখীকরণ ও তরুণদের নানা ক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তোলা। তাইতো এসব লক্ষ্য পূরণ করতে আরব দেশ ও চীনের মধ্যে আধুনিক ‘সিল্ক রোড’ তৈরিরও ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরবের বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়।
সম্মেলনের এক পর্যায়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি আরবের বিনিয়োগ উপমন্ত্রী সালেহ খাবতি বলেন, চীনের প্রস্তাব করা বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মাধ্যমে খুব সহজে ইউরোপের সঙ্গে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের সংযাগ ঘটানো যাবে। তিনি বলেন, এই সংযোগ ৩ মহাদেশে বিনিয়োগ যেমন বাড়বে তেমনি অর্থনৈতিক নানা সূচকে এগিয়ে যাবে এখানকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। চীনা গণমাধ্যমে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ১০ম আরব-চীন বিজনেস কনফারেন্স এসব সম্ভাবনাকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
সালেহ খাবতি, বিনিয়োগ উপমন্ত্রী, সৌদি আরব
“চীনা কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা কেবল কেমিকেল ও জ্বালানী খাতেই সম্ভাবনাই উন্মুক্ত করেনি বরং রিয়েল এস্টেট, উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও সুযোগ বাড়িয়েছে। সৌদি আরব, আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও চীনের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে অসীম সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে।“
সৌদি আরবের বিনিয়োগ মন্ত্রনালয়ে বলছে, মেরিটাইম সিল্ক রোডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ৩ মহাদেশের সঙ্গে চীনের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার অনন্য সম্ভাবনা আছে সৌদি আরবের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত শহরগুলোর। এতে আফ্রিকা থেকে পণ্য মাত্র ৪ দিনে সহজে ও কম খরচে পৌঁছে যেতে পারবে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এ কারণে নিজ দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের আহ্বান জানায় সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংযোগ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ যেমন বাড়াবে বাণিজ্য ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কানেক্টিভিটি তৈরি হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান।
ভিনদেশে চীন:
মিশরে কারখানা স্থাপন করছে হায়ার
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: উত্তর আফ্রিকার দেশ মিশরে এবার নিজেদের প্রথম কারখানা স্থাপন করে যাচ্ছে চীনের বৃহত্তম গৃহস্থালী পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি হায়ার। স্থানীয়দের কর্মসংস্থান ও দেশটির উৎপাদনখাতে এই উদ্যোগ অনকে বড় অবদান রাখবে বলে মনে করে কোম্পানিটি।
হায়ার গ্রুপের ভর্তুকি প্রতিষ্ঠান হায়ার স্মার্ট হোমের বিনিয়োগে তৈরি করা প্রতিষ্ঠান হায়ার ইজিপশিয়ান ইকোলজিক্যাল পার্ক বলছে, এখানে অন্তত ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। কারখানাটির মোট আয়তন ২ লাখ বর্গ মিটার।
মিশরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শারকিয়া প্রদেশের রামাদান শহরে এ কারখানাটি নির্মাণ করা হচ্ছে। মিশরের জেনারেল অথোরিটি ফর ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ফ্রি জোনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাম হাইবা বলেন, এই বিনিয়োগ চীন ও মিশরের মধ্যকার সম্পর্ক ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। কর্তৃপক্ষ বলছে, এই কোম্পানির মাধ্যমে অন্তত ২ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
মিশরে অবস্থিত চীনা দূতাবাসের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ক মিনিস্টার কাউন্সিলর ছৌ ছেনছেন বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মিশরে আরও বেশি চীনা বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। প্রকল্পের প্রথম অংশের কাজ শুরু হবে ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে। এই অংশে এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, টিভি উৎপাদনের কাজ হবে। আর দ্বিতীয়ার্ধের কাজের মধ্যে আছে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদন বিষয়ক অবকাঠামো নির্মাণ।
হায়ার স্মার্ট হোমের চেয়ারম্যান ও প্রসিডেন্ট লি হুয়াছাং বলেন, হায়ার ইকোলজিক্যাল পার্ক হতে যাচ্ছে কোম্পানিটির একটি আঞ্চলিক উৎপাদন কেন্দ্র। এখান থেকেই মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
কোম্পানি প্রোফাইল:
চীনে দুই অংকের ব্যবসা প্রবৃদ্ধি অর্জনে মরিয়া ক্রাফ্ট হাইন্জ
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীনে নিজেদের পণ্যের বাজার দ্বিগুণ সম্প্রসারণ করতে মোটা অংকের বিনিয়োগ নিয়ে আসছে মার্কিন খাদ্য ও কোমলপানীয় উৎপাদনকারী জায়ান্ট ব্র্যান্ড ক্রাফ্ট হাইন্জ। কোম্পানিটির বিশ্বাস করোনা পরবর্তী সময়ে বাজারে পণ্যের দ্বিগুণ চাহিদা তৈরি করতে সক্ষম হবে তারা। লক্ষ্য অর্জনে এরইমধ্যে ধারাবাহিক বিনিয়োগ কার্যক্রম শুরু করেছে কোম্পানিটি।
ক্রাফ্ট হাইন্জ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিগুয়েল প্যাট্রিকো জানান, বাজারে চাহিদার গতিপ্রকৃতি বুঝে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। তবে গ্রাহকদের পছন্দকেই সবার আগে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
চীনা গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্যাট্রিসিও জানান, চীনা বাজারের আকার বিশাল। তিনি জানান, বাজারের আকার বিবেচনায় চীনে তাদের কার্যক্রম খুবই ছোট পরিসরে আছে। চীনের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে খাদ্যের মতো খাতে এখানকার বাজারে ভালো ব্যবসার সুযোগ আছে।
চীনে বিনিয়োগ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কোম্পানিটি সিঙ্গাপুর থেকে তাদের এশিয়া অঞ্চলের সদর দফতর সাংহাইতে স্থানান্তর করেছে। এখানে একটি এক্সপেরিয়েন্স সেন্টার চালু করতে ব্যয় করেছে ২৭ মিলিয়ন ইউয়ান। এই সেন্টারে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ওয়েস্টার্ন কিচেন, চাইনিজ কিচেন, সস ও অন্যান্য পণ্যের প্যাকেজিং ল্যাব। অন্যদিকে ২০২১ সালে শানতোং প্রদেশে কেচাপ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করতে ব্যয় করেছে সাড়ে ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪৭ মিলিয়ন ইউয়ান। সব মিলিয়ে গেল ৫ বছরে কোম্পানিটি চীনে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ২৮০ মিলিয়ন ইউয়ান।
বর্তমানে চীনের কেচাপ মার্কেটের ২৭ শতাংশ ক্রাফ্ট হাইন্জের দখলে। কোম্পানিটির প্রত্যাশা, চলতি বছর দুই অংকের প্রবৃদ্ধির দেখা পাবে চীনের বাজারে।