চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান
‘চলতি বাণিজ্য’
চলতি বাণিজ্যের ১৪ম পর্বে থাকছে:
১. হাইনান এক্সপো: ক্রেতা ও বিনিয়োগ আকর্ষণের প্ল্যাটফর্ম
২. মালয়েশিয়ার গাড়িশিল্পের ইলেক্ট্রিক রূপান্তর ঘটাচ্ছে চীন
৩. চীনে কার্যক্রম বাড়িয়েই চলেছে জার্মান স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি
হাইনান এক্সপো: ক্রেতা ও বিনিয়োগ আকর্ষণের প্ল্যাটফর্ম
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করে পর্দা নামলো ৬ দিনব্যাপী চীনের বিখ্যাত ভোগ্যপণ্য প্রদর্শনী বা হাইনান এক্সপো। দক্ষিণ চীনের হাইনান প্রদেশে তৃতীয় বারের মতো বসে এই আন্তর্জাতিক মেলা। এবারের মেলায় অংশ নেয় চিলি, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ সারা বিশ্বের ৬৫টি দেশ ও অঞ্চলের ৩ হাজার ৩শ’ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চীনের বাজারে প্রবেশ ও চীনে বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই ভোগ্যপণ্য মেলা। দেখুন আমার তৈরি করা একটি প্রতিবেদন।
চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হাইনানের রাজধানী হাইকৌ শহরে বসে বিভিন্ন দেশের মানুষের মিলন মেলা। সাধারণ মানুষ নয়, বরং বিশ্বের সেরা ৫শ’ কোম্পানির ৩০জন প্রধান নির্বাহীসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা আসেন এখানে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিরা। এর পাশাপাশি স্থানীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাতো আছেনই।
লক্ষ্য, চীনের বিশাল বাজারে নিজেদের উৎপাদন করা সেরা পণ্যটি প্রদর্শন। পাশাপাশি লক্ষ্য চীনের বাজারে বিনিয়োগ করে বাড়তি লাভের ভাগ বুঝে নেওয়া।
পরিসংখ্যান বলছে, চীনের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৪০ কোটিই মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই বাজার ধরতে মরিয়া বিভিন্ন দেশের পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের বাজারে বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রবেশ ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এক বিশাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে এই আন্তর্জাতিক ভোগ্যপণ্য মেলা বা হাইনান এক্সপো।
এমনই একটি প্রতিষ্ঠান চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব ট্রপিক্যাল এগ্রিকালচারাল সায়েন্স। নিজেদের উদ্ভাবন করা সেরা পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনের গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই মেলায় হাজির হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এখানকার টেকনোলজি ট্রান্সফার সেন্টারের পরিচালক লিয়াও জিরং জানান, এখন পর্যন্ত ৪শ; রকমের জলবায়ু সহনশীল কৃষি পণ্য উৎপাদন করছেন তারা।
লিয়াও জিরং, পরিচালক, চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব ট্রপিক্যাল এগ্রিকালচারাল সায়েন্স
“আমরা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উন্নত জাতের অন্তত ৪শ’টি কৃষিপণ্য উদ্ভাবন করেছি। গেল বছরও এই মেলা কোকোয়া বিনস বেলজিয়ামে রফতানির আদেশ পাই। এ বছর জার্মানির ক্রেতাদের সঙ্গে কফি রফতানির চুক্তি সই করেছি। আমরা আশা করি এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হাইনানেন উন্নত জাতের ফসল সারা বিশ্বে পৌছে দিতে পারবো।“
মেলায় নিজেদের পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছে চিলি, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ সারা বিশ্বের ৬৫টি দেশ ও অঞ্চল থেকে অংশ নিয়েছে ৩ হাজার ৩শ’ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। জার্মানির বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফোক্সভাগেনও যোগ দিয়েছে প্রদর্শনীতে। নিজেদের তৈরি করা সবশেষ নতুন মডেলের গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে চীনের ক্রেতাদের কাছে। ফোক্সভাগেনের চীনা অঞ্চলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিফেন মেশা জানান, গেল ৪ দশকে চীনের বাজারে ব্যবসা পরিচালনার ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের।
স্টিফেন মেশা, প্রধান নির্বাহী, ফোক্সভাগেন কার ফর চায়না
“আমাদের দুটো বড় অংশীদারী কোম্পানি হলো জার্মানির সাইক ফোক্সভাগেন ও ফাও ফোক্সভাগেন। আমাদের এই অংশীদারিত্ব এতোটাই মজবুত যে গেল ৪০ বছর ধরে এটি চলছে। এই দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ও একত্রে পথচলায় আমরা আরো নিত্য নতুন মডেলের গাড়ি তৈরি করতে চাই, বিশেষ করে ইলেক্ট্রিক গাড়ি তৈরিতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে চাই। আমাদের পরিকল্পনা হলো, ২০২৪ সালের মধ্যে চীনে আমরা ১১০ বিলিয়ন ইউয়ান বিনিয়োগ করবো।“
এবারের মেলায় কয়েক হাজার নতুন পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছে কয়েক শ’ কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদিত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পণ্য, আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব স্মার্ট পণ্য ও ফ্যাশন সামগ্রী।
কেবল পণ্য নয়, এই মেলায় ছিলো বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় করিয়ে দেওয়ার অন্তত ২শ’ ম্যাচমেকিং উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। অনলাইন ও অফলাইনে নানা রকমের সেবার প্রতিশ্রুতিয়ে নিয়ে হাজির ছিলো তারা। মেলা কর্তৃপক্ষ জানায়, এবার মেলার পরিসর গেলবারের চেয়ে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ১ লাখ বর্গমিটার।
আয়োজকরা বলছেন, গেল ৫ বছরে হাইনানে যে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে স্থানীয় ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন করা হয়, বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চীনের বাজারে প্রবেশ উৎসাহিত করতে ও চীনে বিনিয়োগ করতে ‘লেটিং ফার্মস ইন অ্যান্ড ডু বিজনেস’ নীতি নেওয়া হয়। পাশাপাশি হাইনানের ফ্রি ট্রেড পোর্ট নীতির সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এখানে আসতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল বিনিয়োগ ও বাণিজ্যেই ভূমিকা পালন করছে না বরং হাইনানের পর্যটন বিকাশে সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি হাইনান হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক ভোগ্যপণ্য ও সেবা প্রচারণার প্রাণকেন্দ্র।
ভিনদেশে চীন:
মালয়েশিয়ার গাড়িশিল্পের ইলেক্ট্রিক রূপান্তর ঘটাচ্ছে চীন
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: সারা বিশ্বের মতোই নিজ দেশের গাড়ি তৈরি শিল্পে জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানীতে রূপান্তর ঘটাচ্ছে মালয়েশিয়া। আর বিশাল এই কার্যক্রমে পাশে দাঁড়িয়েছে চীন।
চীনের বিদ্যুৎচালিত গাড়ি তৈরির অন্যতম প্রতিষ্ঠান গ্রেট ওয়াল মোটর –জিডাব্লিউএম এ বিষয়ে কাজ করছে মালয়েশিয়ায়। জিডাব্লিউএমের তৈরি করা অত্যাধুনিক বিদ্যুৎচালিত গাড়ি ‘ওরা গুড ক্যাট’ এখন বেশ জনপ্রিয় মালয়েশিয়ায়। চলতি বছরের শুরুর দিকে বেশ কয়েকজন গ্রাহক এ গাড়িটি অর্ডার করলে দ্রুত তাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয় গাড়িটি।
২০২২ সালে প্রথম মালয়েশিয়ায় কোম্পানি স্থাপন করে জিডাব্লিউএম। গ্রেটওয়াল মোটর সেলস মায়েশিয়া’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক চুই আনকি জানান, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বিশেষ করে এই দেশে গাড়ির অনেক ক্রেতা। কিন্তু পরিবেশবান্ধব জ্বালানীচালিত গাড়ির কথা বিবেচনায় নিলে বলা যায় এদেশের বাজার এখন এক বিশাল নীল সমুদ্র। কাজেই এই সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছি। এদিকে, গেল বছর চীনা গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি আনুষ্ঠানিকভাবে মালয়েশিয়ায় তাদের উৎপাদন করা নতুন মডেলের গাড়ি ‘আট্টো-থ্রি’ উদ্বোধন করে।
মালয়েশিয়ান অটোমোটিভ অ্যাসোসিয়েশনের প্রকাশ করা তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালে মালয়েশিয়ায় বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বিক্রি হয় ২ হাজার ৬৩১টি। অথচ ২০২১ সালে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বিক্রির সংখ্যা ছিলো ২৭৪টি। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়েছে ৮৬০ শতাংশ।
এক বছরের ব্যবধানে মালয়েশিয়ায় পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎচালিত গাড়ির সংখ্যা বিপুল সংখ্যা বাড়ার পেছরে সরকারের নীতিসহায়তা ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে বলে জানান দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী টেংকু জাফরুল টেংকু আব্দুল আজিজ। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে মালয়েশিয়ায় সংযোজন করা গাড়ির আমদানি শুল্ক ও বিক্রয় কর পুরো মওকুফ করা হয়েছে।
গাড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, প্রথাগত জ্বালানীর পরিবর্তে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি তৈরির যে ট্রেন্ড চলছে তার সঙ্গে তালমিলিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে মালয়েশিয়ার গাড়ি তৈরি শিল্পেও। মালয়েশিয়ার বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী টেংকু জাফরুল টেংকু আব্দুল আজিজ বলছেন, তার দেশের জাতীয় জ্বালানী নীতি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদিত মোট গাড়ির ১৫ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদিত গাড়ির ৩৮ শতাংশই বিদ্যুৎচালিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ২০২৫ সালের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ১০ হাজার পাবলিক চার্জিং সুবিধা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কোম্পানি প্রোফাইল:
চীনে কার্যক্রম বাড়িয়েই চলেছে জার্মান স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীনে নিজেদের কার্যক্রম বাড়িয়েই চলেছে জার্মানির স্বাস্থ্যসেবাপণ্য উৎপাদনকারী জায়ান্ট কোম্পানি ফ্রেজেনিয়াস কাবি (নানছং) কোম্পানি লিমিটেড।
গেল ২০ বছর ধরে চীনের বাজারে ব্যবসা পরিচালনা করছে এই কোম্পানিটি। প্রতি বছরই এই কোম্পানির উৎপাদন করা পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে। ফলে বছর বছর বিনিয়োগ ও কার্যক্রম বাড়াচ্ছে এটি।
জার্মানির ফ্রাংকুর্ট শহরের কাছে অবস্থিত বাড হমবুর্গভিত্তিক কোম্পানি ফ্রেজেনিয়াস কাবি। ২০০২ সালে এটি পূর্ব চীনের চিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী নানছংয়ে কার্যক্রম ও বিনিয়োগ শুরু করে। এর পর থেকেই গেল ২০ বছরে একের পর এক নতুন পণ্য বাজারে এনেছে ফ্রেজেনিয়াস কাবি। এ জন্য এ পর্যন্ত অন্তত ৪ বার কোম্পানির কার্যক্রম বাড়িয়েছে এবং বিনিয়োগ করেছে ৫০০ মিলিয়ন ইউয়ান বা ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে একটি স্বয়ংক্রিয় রক্তের উপাদান পৃথক করার উপাদান তৈরি নিয়ে কাজ করছে এটি।
ফ্রেজেনিয়াস কাবি (নানছং) কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক ছ্যাং কুয়াংচোং জানান, সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছর পণ্য উৎপাদন কার্যক্রমকে স্থানীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হবে। ছ্যাং জানান, চীনের বিশাল বাজারে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য পণ্যের চাহিদা পূরণে শিল্প চেইন ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে কাজ চলছে।
পরিসংখ্যান বলছে, চীনের বাজারে কোম্পানিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সক্রিয় পণ্যও এবং যন্ত্রপাতির চাহিদা চলতি বছর ৩৪ শতাংশ বেড়েছে যা গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। এসব পরিসংখ্যানের উদাহরণ টেনে কোম্পানিটির মহাব্যবস্থাপক ছ্যাং কুয়াংচোং জানান, চীনে ব্যবসার পরিবেশ ও বাজারে পণ্যের যে চাহিদা তাই কোম্পানিটিকে আরো বেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। তার প্রত্যাশা, ২০২২ সালের তুলনায় চলতি বছর কোম্পানিটির রফতানি মূল্য ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রকাশ করা এক সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীন বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও উৎসাহিত করতে আরো নানামুখী পদক্ষেপ নেবে। বিশেষ করে চীনের বাজারে বিদেশি কোম্পানি ও তাদের প্রস্তুত করা পণ্যের প্রবেশ উৎসাহিত করতে সেবাখাতে আধুনিকায়ন করছে, বিদেশি বিনিয়োগের কোম্পানিগুলোকে দেশীয় কোম্পানিগুলোর মতোই সুবিধা দিচ্ছে।