চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান‘চলতি বাণিজ্য’
চলতি বাণিজ্যের ১০ম পর্বে থাকছে:
১. ফিরছে অর্থনীতির গতি, জমজমাট বিভিন্ন প্রদেশের রাতের অর্থনীতি
২. ইকুয়েডরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বায়ুভিত্তিক রূপান্তর ঘটিয়েছে চীনা কোম্পানি ডিইসি
৩. বাজার ধরতে চীনে বিপুল বিনিয়োগ মার্সিডিজ বেঞ্জের
ফিরছে অর্থনীতির গতি, জমজমাট বিভিন্ন প্রদেশের রাতের অর্থনীতি
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: কোভিড-১৯ বিষয়ক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পর আবারো আগের রূপে ফিরছে চীনের বিভিন্ন শহর। আবারো জমতে শুরু করেছে রাতের বিভিন্ন বিনোদন আর এসব ঘিরে অর্থনৈতিক বিকাশ। বিশেষ করে চীনের শানসি ও লিয়াওনিং প্রদেশের কর্মসংস্থান, ক্রয় ক্ষমতার হার তরতর করে বাড়ছে সামাজিক সেবাভিত্তিক বিনোদন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
ভায়োলিনের সুরে মেতেছে উত্তর চীনের শানসি প্রদেশের হাজার বছরের পুরনো শহর তাইইউয়ান।
মধ্যরাতেও রাস্তায় পর্যটক ও স্থানীয়দের ভিড়। দীর্ঘ দিন পর আবারো গল্প, আড্ডা আর গানে মাতোয়ারা যেন পুরো শহর।
বন্ধু, পরিবার কিংবা প্রিয়জনের সান্নিধ্যে উপভোগ করছেন রাতের সৌন্দর্য। যেন ঘুম নেই এ শহরের, শহরের বাসিন্দাদের। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা আর তার নান্দনিকতাকে কেউ সাক্ষী বানাচ্ছেন ছবি তুলে। কেউবা ঘুরছেন মন যেদিকে চায় সেদিকে।
স্থানীয়রা বলছেন, আবারো প্রিয় শহরে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে পুরনো দিনের ধুলিপড়া স্মৃতিরা। তারা বলছেন, কোভিডের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর এমন মুক্ত আবহাওয়া তাদের আকর্ষণ করছে এক ভিন্ন মাত্রায়।
“যখন থেকে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হলো তখন থেকেই দেখছি মানুষ রেস্টুরেন্ট ও জামা কাপড়ের দোকানে ভিড় করা শুরু করেছে।“
“এ বছর অর্থনীতি খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভোগের বিষয়ে অনেক বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে রাস্তায় দেখা যায়।“
কোভিড-১৯ এর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় যেন প্রাণ ফিরেছে সব ধরনের পণ্যের দোকানে। বিশেষ করে ঘর সাজানোর জিনিসপত্র থেকে শুরু করে উপহারের ফুল, সব জায়গায় যেন ক্রেতাদের আনাগোনা।
“এখন আমরা অনেক গ্রাহক পাচ্ছি। বিশেষ করে ছুটির দিনে ফুল বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এমনকি চলতি বছর চান্দ্র বর্ষের উৎসবের সময় যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে এখন তার চেয়েও দ্বিগুণ হয়েছে বলা যায়।“
হাজারো বছরের পুরণো সড়ক ধরে গড়ে ওঠা বাজার কেবল অর্থনৈতিক কেন্দ্রই নয়, স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার উপসঙ্গ যেন। আধুনিক সময়ে এসে ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাহারি উপভোগের সামগ্রি। ফলে পর্যটক বা স্থানীয় মানুষ, সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় এই প্রাঙ্গন।
“এখানে এসে আমার খুবই ভালো লাগছে। জায়গাটা আলো ঝলমলে। আমার স্বামীকে আমি বলেছি, রাস্তার দোকানগুলো বেশ সাজানো গোছানো, আমি ভেতরটাও দেখতে চাই।“
এদিকে, সংকটকাল অতিক্রমের পর এমন বাণিজ্যিক পরিস্থিতিকে সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে দেখছে স্থানীয় ছংলোউ বা বেল টাওয়ার স্ট্রিট কর্তৃপক্ষ। তাইইয়ান ছংলোউ স্ট্রিট সমন্বিত সেবাকেন্দ্রের পরিচালক জানান, ভবিষ্যতে পণ্যের গুণগত মান বাড়িয়ে এই মার্কেটকে আরো জমজমাট করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ছ্যাং লুফাং, পরিচালক, তাইইয়ান ছংলোউ স্ট্রিট সমন্বিত সেবাকেন্দ্র
“দেশি ও বিদেশি আরও ভালো কিছু ব্র্যান্ডকে এখানে আনা হবে, তাদেরকে এখানে শো-রুম খোলার অনুমতি দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে এই মার্কেটের ব্র্যান্ড ভ্যালু ও গুণগত মান আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে, ছংলুও সড়কের মার্কেটকে ফ্যাশন বিষয়ক পণ্যের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।“
এদিকে, চীনের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ লিয়াওনিংয়ের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে করোনা সংক্রমণ বিষয়ক বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পর। বিশেষ করে শেনইয়াং শহরের রাতের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে।
নতুন বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের প্রচারণা কার্যক্রম চালাচ্ছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এসব প্রচারণায় দারুণ আকৃষ্ট হন তরুণরা। তাইতো নতুন করে গ্রাহক আকর্ষণ করতে খাবার ও পোশাকের হাল ফ্যাশন, ট্রেন্ড ও রুচির গল্প প্রচারের এমন অভিনব সব আয়োজন।
স্থানীয়রা বলছেন, রাতে নাগরিকদের নেই নিরাপত্তাজনিত কোন ভয় কিংবা শঙ্কা। ফলে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পরই মানুষ আবারো আগের মতোই ফিরছেন রাতের আড্ডায়।
গ্রাহক ও পর্যটকদের মন জয় করার আরও আছে বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক আয়োজন। নাচ, গান ও বিভিন্ন পরিবেশনায় মুগ্ধ আগতরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব আয়োজন কেবলই উদযাপনের অনুসঙ্গ নয়। বরং এর সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতি। সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান, ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে স্থানীয়দের। আবার ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে বাড়ছে একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও সামাজিক বন্ধন।
ভিনদেশে চীন:
ইকুয়েডরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বায়ুভিত্তিক রূপান্তর ঘটিয়েছে চীনা কোম্পানি ডিইসি
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: ইকুয়েডরে স্থাপন করা সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বায়ুভিত্তিক রূপান্তর ঘটিয়েছে চীন। চীনের তোংফ্যাং ইলেক্ট্রিক কর্পোরেশন –ডিইসি এই কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৪টি ইউনিটেরই রূপান্তর কার্যক্রম শেষ হয়েছে, যুক্ত করা হয়েছে দেশটির মূল সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে। তাদের দাবি, জাতীয় গ্রিডের বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়াকেই উৎসাহিত করা ও প্রথাগত বিদ্যুৎ উৎস থেকে বের হতে সাহায্য করবে ইকুয়েডরকে।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে স্থাপন করা সব বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশ বান্ধব বায়ুভিত্তিক কেন্দ্রে রূপান্তর করছে চীনা কোম্পানি তোংফ্যাং ইলেক্ট্রিক কর্পোরেশন –ডিইসি। এর অংশ হিসেবে ইকুয়েডরের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৪টি ইউনিটেই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। সম্প্রতি এসব কেন্দ্রে উৎপাদন করা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় মূল সঞ্চালন লাইনে। কোম্পানিটি বলছে, নির্ধারিত সময়ের ২০ দিন আগেই সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের রূপান্তর কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ইকুয়েডরের আন্দেস প্রদেশে স্থাপন করা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। একক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনের হিসেবে এটি ইকুয়েডরের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। আবার দক্ষিণ আমেরিকায় ডিইসি’র স্থাপন করা চীনা বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবেও এর অবস্থান প্রথম।
চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নকশা প্রণয়ন, কাঁচামাল সরবরাহ ও পরিবহন, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ স্থাপন, কার্যক্রম চালু করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া পরীক্ষা-নীরিক্ষা, প্রাথমিক উৎপাদন শুরু করার কাজ করছে তোংফ্যাং ইলেক্ট্রিক কর্পোরেশন –ডিইসি। পাশাপাশি পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৪ সেট উইন্ড টার্বাইন, ট্রান্সফরমার বক্স ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাপনার কাজও করবে ডিইসি।
কোম্পানিটি বলছে, পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবগুলো ইউনিটের এই রূপান্তর কাজ ইকুয়েডরের জাতীয় গ্রিডের বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়াকেই উৎসাহিত করবে না বরং প্রথাগত বিদ্যুৎ উৎস থেকে বের হতেও সাহায্য করবে।
কোম্পানি প্রোফাইল:
বাজার ধরতে চীনে বিপুল বিনিয়োগ মার্সিডিজ বেঞ্জের
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: পরিবেশ বান্ধব শিল্প উৎপাদনের অংশ হিসেবে নতুন ধরনের জ্বালানী চালিত গাড়ি তৈরি উদ্যোগ নিয়েছে জার্মানি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মার্সিডিজ বেঞ্জ। এরই অংশ হিসেবে চীনে বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে আসছে কোম্পানিটি। বিশেষ করে ইলেক্ট্রিক গাড়ি, ডিজিটালাইজেশন এবং শূন্য কার্বন উৎপাদনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে কোম্পানিটি। আর পুরো প্রক্রিয়ায় থাকবে চীনা অংশীদারিত্ব। আমার তৈরি করা প্রতিবেদন জানাচ্ছেন নাজমুল হক রাইয়ান।
চীনের বাজার ধরতে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ নিয়ে আসছে জার্মানির বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মার্সিডিজ বেঞ্জ। তবে বিনিয়োগ হবে চীনের একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে।
সম্প্রতি চীনা গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন গ্রেটার চীনে কাজ করা মার্সিডিজ বেঞ্জ গ্রুপ এজি’র ব্যবস্থাপনা বোর্ডের সদস্য হুবার্টাস ট্রসকা। তিনি জানান, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং শিল্প চেইনে বিনিয়োগে আগ্রহী মার্সিডিজ বেঞ্জ। বিশেষ করে ইলেক্ট্রিক গাড়ি তৈরি, ডিজিটালাইজেশন, শূন্য কার্বন উৎপাদন ব্যবস্থায় বেশি মনোযোগ দিতে চায় কোম্পানিটি। এর পাশাপাশি চীনের গ্রাহকদের জন্য আরো আরামদায়ক ও ভ্রমণবান্ধব গাড়ি উপহার দিতে চায় মার্সিডিজ।
মার্সিডিজ বেঞ্জের সবচেয়ে বড় বাজার ও উৎপাদন কেন্দ্র এই চীন। একইসঙ্গে বৈশ্বিক উৎপাদন চেইনের উন্নয়নে চীনের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ভালো ভূমিকা পালন করছে বলেও জানান তিনি। বিশেষ করে দীর্ঘ মেয়াদে বৈশ্বিক বাজারের কৌশলগত নীতি নির্ধারণে চীনের বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিস্থিতি ভূমিকা পালন করে বলেও জানান এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
বর্তমানে পরিবেশবান্ধব নতুন জ্বালানী চালিত গাড়ি তৈরির দিকে ঝুঁকছে মার্সিডিজ বেঞ্জ। এ লক্ষ্যে ২০১৯ সালে হাতে নেওয়া হয়েছে ‘লক্ষ্য ২০৩৯’। এই পরিকল্পনার আওতায় ২০৩৯ সালের মধ্যে শূন্য কার্বন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে মার্সিডিজ। এরইমধ্যে গেল বছরের চেয়ে চলতি বছর ১৪৩ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কোম্পানিটি।