চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘চলতি বাণিজ্য’
চলতি বাণিজ্যের ৬ষ্ঠ পর্বে যা থাকছে:
১. হংকংয়ের বিনিয়োগ চায় কুয়াংতোং ও হাইনান, খুলেছে সব বন্দর
২. মার্কিন গাড়ি নির্মাতা ফোর্ডকে প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে চীনা কোম্পানি সিএটিএল
৩. চীনা বাজার ধরতে মরিয়া কোকা-কোলা
হংকংয়ের বিনিয়োগ চায় কুয়াংতোং ও হাইনান, খুলেছে সব বন্দর
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: আকাশ ছোঁয়া ভবন আর চাকচিক্যের শহর হংকং। এখানকার তরুণরা যেমন দক্ষ ও মেধাবী, তেমনি হংকংয়ের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সক্ষমতাও ব্যাপক। এসব সুযোগ কাজে লাগাতে করোনা সংক্রমণ কমার পরপরই হংকংয়ের সঙ্গে খুলে দেওয়া হচ্ছে চীনের মূল ভূ-খণ্ডের সব প্রবেশ পথ। এমনই মাতৃভূমির সঙ্গে যোগাযোগের সবগুলো বন্দরও খুলে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে চীনের কুয়াংতোং ও হাইনানের সঙ্গে হংকংয়ের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পাচ্ছে ভিন্ন মাত্রা।
চীনের সঙ্গে পুরো বিশ্বের যোগাযোগের দ রজা বলা হয় হংকংকে। কিন্তু করোনা মহামারির ফলে দীর্ঘ সময় বিশেষ ব্যবস্থায় সীমিত পরিসরে এই অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো চীনের। এবার খুললো সেই অচলায়তন।
দীর্ঘ ৩ বছর পর চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হংকংয়ের সঙ্গে মূল ভূ-খণ্ডের আবারো পুরোদমে চালু হলো যোগাযোগ। খুললো চীনের সবগুলো বন্দর। বিশেষ করে প্রযুক্তি হাব বলে পরিচিত কুয়াংতোং প্রদেশের শেনছেন শহরের সঙ্গে হংকংয়ের সবগুলো যোগাযোগ গেট খুলে দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি।
এরইমধ্যে পর্যটক, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ চীন ও হংকংয়ের মধ্যে যাতায়াত শুরু করেছেন। অনেকে যাচ্ছেন অন্য পাড়ে থাকা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে। এমনই একজন ভ্রমণকারী বলছিলেন নিজের অনুভূতির কথা।
পর্যটক
“কোভিড শুরু হওয়ার আগে আমরা হুয়াংক্যাং বন্দর ব্যবহার করতাম, কারণ এটা প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকতো। করোনার পর এটা আবারো খুলেছে, সবকিছুই স্বাভাবিক ও সহজ দেখছি। এখানকার কর্মীরাও খুব বন্ধুবৎসল, আমরা যা কিছু জানতে চেয়েছি তারা ব্যাখ্যা করেছে।“
এই যোগাযোগ কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। বরং বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের দরজাও উন্মুক্ত করেছে নতুন করে। পণ্য আনা নেওয়া থেকে শুরু করে প্রতি দিনের লেনদেন চালু হয়েছে হংকংয়ের সঙ্গে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, হংকং কিংবা মূল ভূ-খণ্ডের কোন ব্যক্তির ভ্রমণের ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, উৎসাহিত করা হচ্ছে গ্রুপ ভ্রমণকেও।
এদিকে, দীর্ঘ দিনের যোগাযোগ ও বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে নিতে হংকংয়ের সঙ্গে সহযোগিতা আরো বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে চীনের টেকহাব হিসেবে পরিচিত হাইনান প্রদেশ। হংকংয়ের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, হাইনানে বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে চান তারা।
জনাথন চোই কুনশুম, চেয়ারম্যান, চাইনিজ জেনারেল চেম্বার অব কমার্স, হংকং
“হাইনানের বন্দরে করের বিষয়ে যে নীতি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার জন্য আমরা আনন্দিত। হাইনানের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ আছে। সেখানে আমরা বিনিয়োগ করতে চাই, বিশেষ করে নতুন উদ্যোগ শুরু ব্যাপারে কাজ করতে চাই।“
দক্ষিণাঞ্চলীয় এই প্রদশটির বন্দরে বাণিজ্য সুবিধা সৃষ্টি করতে গঠন করা হয়েছে ফ্রি ট্রেডের ব্যবস্থা। বিশেষ করে হাইনানের নির্মাণ খাত উন্মুক্ত করা হয়েছে হংকংয়ের জন্য। তাইতো হংকংয়ের সুউচ্চ ভবন তৈরি করার দক্ষতা ও জ্ঞান কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে হংকংয়ের মেধাবীদের।
ছেং ছিছি, উপ-পরিচালক, লিডিং গ্রুপ অফিস, সিংইং বে পোর্ট
“প্রথমত হংকংয়ের বিনিয়োগকারীরা এখানে বন্দরের কাছাকাছি বিশাল আকারের জমির সুবিধা পাবে। আবার আমরা নতুন শহর নির্মাণ করছি, সেখানেও হংকংয়ের অবিজ্ঞতা, অর্থ ও তাদের জ্ঞান কাজে লাগানো যায়। কেননা, নতুন নতুন ভবন তৈরিতে তাদের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। কাজেই আমাদের আন্তর্জাতিক যে ফ্রি ট্রেড পোর্ট আছে সেখানে তারা বিনিয়োগ করতে পারে। সেই বিনিয়োগ থেকে একটি বড় অংকের লাভ ঘরে তোলা সম্ভব।“
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত হাইনানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশও আসে হংকং থেকে। এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এসব বিনিয়োগে অংশ নেয় হংকংয়ের ২ হাজারের বেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
ভিনদেশে চীন:
মার্কিন গাড়ি নির্মাতা ফোর্ডকে প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে চীনা কোম্পানি সিএটিএল
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: কেবল মার্কিন বাজার নয়, দুনিয়া জোড়া খ্যাতি যুক্তরাষ্ট্রের জায়ান্ট গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ড মোটর কোম্পানি। এই ফোর্ডের তৈরি করা গাড়ির জন্য যে নতুন ব্যাটারি প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে প্রযুক্তিগত সব সেবা দেবে চীনা কোম্পানি কনটেম্পোরারি অ্যামপেরেক্স টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড –সিএটিএল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে স্থাপন করা প্ল্যান্টে এক সঙ্গে কাজ করবে চীনের ব্যাটারি নির্মাতা এই প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে ল্যাটার্স লিথিয়াম আয়রন ফসফেট বা এফএফপি ব্যাটারি তৈরির ব্যাপারে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সেবা দেবে তারা।
সাংহাই সিকিউরিটিস নিউজ জানায়, এরইমধ্যে নতুন স্থাপন করা প্ল্যান্টটিতে সাড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে ফোর্ড। বিশেষ করে ২০২৬ সালে ফোর্ড মোটরের জন্য ৪ লাখ বিদ্যুৎচালিত গাড়ির জন্য ব্যাটারি উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কোম্পানিটি। আর সে কারণেই চীনা কোম্পানি সিএটিএলও শুরু করেছে তৎপরতা। সিএটিএল জানায়, নতুন প্ল্যান্টে উৎপাদন করা ব্যাটারিতে ব্যবহার করা প্রযুক্তির প্যাটেন্টের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করবে তারা।
এর আগে ২০২২ সালে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে উভয় কোম্পানি।
কোম্পানি প্রোফাইল:
চীনা বাজার ধরতে মরিয়া কোকা-কোলা
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীনের বাজার ধরতে কার্যক্রম জোরদার করেছে মার্কিন বহুজাতিক কোমল পানীয় প্রস্তুতকারক কোম্পানি কোকাকোলা।
এ জন্য অফলাইন ও অনলাইনে কোম্পানির পণ্যের প্রচারণা বাড়ানো, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন এবং উৎপাদনে আরো বেশি বিনিয়োগ করার উপর জোর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব কার্যক্রমের কিছু প্রমাণও মিলেছে গেল বছরের কার্যক্রমে। বিশেষ করে ২০২২ সালেই চীনে নতুন করে আরো ২০টি পণ্য বাজারজাত করা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া প্রদেশের আটলান্টা ভিত্তিক দ্য কোকা-কোলা কোম্পানি।
চীনের বাজার প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেমস কুইনসে সম্প্রতি বলেছেন, চীনের বাজারে কোকাকোলার নতুন পণ্য ও বিনিয়োগ ব্যবসায় আরো বেশি মুনাফা নিয়ে আসবে। নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০১৯ সালে করোনার প্রভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে গেল বছর কোকা-কোলার বাজার ১ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। বিশেষ করে ভারত ও ভিয়েতনামে কোকো-কোলার বাজার কিছুটা চাঙ্গা হলেও চীনের বাজারে চাহিদা কিছুটা কমে যায়।
চীনের খাদ্য ও পানীয় খাতের বিশ্লেষক ছু তানপেং কোকা-কোলার বিনিয়োগ ও বাজারজাতকরণ নীতি বিশ্লেষন করেছে বলেছেন, চলতি বছর কোকা-কোলা চীনের বাজারে প্রায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং গেল বছরের যে মন্দাভাব সেটা কেবলই ক্ষণস্থায়ী।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী কোকা-কোলার বাণিজ্য ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এসব বাণিজ্য থেকে কোকাকোলার ব্যবসায়ীক লাভ হয়েছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
এদিকে ডিজিটাল মাধ্যমে চীনের ক্রেতাদের কাছাকাছি আসতে অনলাইনে প্রচারণা বাড়িয়েছে কোকা-কোলা। বিশেষ করে আলিবাবা ও জেডি’র মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার পণ্যের জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
চীনের বাজার ধরার জন্য এখানে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে এসেছে কোকা-কোলা। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে বৃহত্তর চীন ও মঙ্গোলিয়া অঞ্চলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় গিলেস ল্যাকলার্ককে। তিনি এর আগে দ্য কোকা-কোলা কোম্পানির ম্যাকডোনাল্ডস ডিভিশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।