বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং: ‘ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে’
আফরিন মিম, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর প্রভাবে বাংলাদেশের রাজধানীসহ অন্তত ২০ জেলায় বাড়ি ও উম্মুক্ত স্থানে, বিশেষ করে, পার্ক ও সামাজিক বনায়ন হয়েছে এমন এলাকায় অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়েছে অনেক এলাকা। ঝোড়ো হাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার বাড়িঘর, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে মাছের ঘের। ধসে গেছে কাঁচাপাকা বাড়ি, তলিয়ে গেছে মৌসুমি ফসল, নষ্ট হয়েছে ফল-ফলাদির গাছ। বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা।
২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় ভোলার কাছ দিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং।
প্রকৃতি ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশ উপকূলে আঘাতের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার।
সিত্রাংয়ের প্রভাবে সারাদেশ জুড়েই নানা খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বরিশাল
ক্ষয়ক্ষতিতে বরিশাল জেলার অবস্থান তৃতীয়। এ জেলায় ১ হাজার ৮৪৩টি দিঘি, পুকুর ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ হাজার ৪১৬ জন খামারি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ভেসে গেছে ৫৮৫ মেট্রিক টন মাছ; এর মধ্যে পোনা ২৪ লাখ। ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পোনা ভেসে গেছে ৫৪ লাখ টাকার। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৯৯ লাখ টাকার। মোট ক্ষতির পরিমাণ ৮ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
ভোলা
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ভোলা জেলায়। ভোলায় ৬ হাজার ২৮০টি দিঘি, পুকুর ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪৩৭ তশমিক ৩৭ মেট্টিক টন মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৬ কোটি ৫৬ লাখ ৪ হাজার টাকা।
পটুয়াখালী
পটুয়াখালী জেলায় মোট ৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। পটুয়াখালীতে ২ হাজার ১৩২টি দিঘি, পুকুর ও খামারের এক হাজার ৮৫০ জন খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪১৪ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। এর মধ্যে নার্সারী মালিকের মাছের পোনা রয়েছে ৪৩ লাখ।
মাছ ভেসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। পোনা ভেসে যাওয়ায় নার্সারী মালিকের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এছাড়া অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টাকার। ৫০টি নৌকা ও ট্রলার ডুবে গেছে এ জেলার।
ঝালকাঠি
ঝালকাঠি জেলায় ৯১৪টি দিঘি, পুকুর ও খামার ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ৮৩১। মাছ ভেসে গেছে ৮৩ দশমিক ৭০ মেট্রিক টন। নার্সারী থেকে পোনা ভেসে গেছে ২ লাখ ১১ হাজার। ভেসে যাওয়া মাছের মূল্য ১ কোটি ৫৪ লাখ ১ হাজার টাকা। ভেসে যাওয়া পোনার মূল্য ১৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। অবকাঠামোগত ক্ষতি ১০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। মোট ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৭৭ লাখ ২১ হাজার টাকা।
বরগুনা
বরগুনা জেলায় ভেসে গেছে ৪৬৮ দিঘি, পুকুর ও খামার। চাষির সংখ্যা ৩৯৩। মাছ ভেসে গেছে ৮৩ মেট্রিক টন। নার্সারী থেকে পোনা ভেসে গেছে দুই লাখ। ভেসে যাওয়া মাছে ক্ষতি হয়েছে ৯৯ লাখ টাকা। সাত লাখ টাকার পোনা ভেসে গেছে। নৌকা ও ট্রলার ডুবেছে ৫টি। ক্ষতি হয়েছে ৬ লাখ টাকা। অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে ৮ লাখ টাকা। মোট ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা।
পিরোজপুর
পিরোজপুর জেলায় ক্ষতি হয়েছে ৩৭৫টি দীঘি, পুকুর ও খামার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪১৯ জন। মাছ ভেসে গেছে ১২৭ মেট্রিক টন। ভেসে যাওয়া মাছের মূল্য এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। মোট ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
মুন্সিগঞ্জ
মুন্সীগঞ্জে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ৭৫০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এতে কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জে ইতোমধ্যে শীতকালীন সবজি চাষ শুরু হয়েছে। কিন্তু সবজি ক্ষেতগুলো ঝড়-বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জ, টঙ্গিবাড়ী ও সিরাজদিখান উপজেলায় এবার সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩৮৭ হেক্টর জমিতে আগাম সবজির চাষ হয়েছে। এসব সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো ও শালগম প্রধান। সোমবার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ১৯০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ২৬০ হেক্টর রোপা আমন, এক হেক্টর করে মরিচ, খেসারি, কলাইয়ের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নোয়াখালী
নোয়াখালীতে পাঁচটি উপজেলায় কমপক্ষে ১ হাজার ৩০৩টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে হাতিয়ার ৪৪০টি বাড়িঘর। খুলনায় ১ হাজার ৬০০ ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় ও কোথাও বেড়িবাঁধ ভাঙার খবর পাওয়া যায়নি। ক্ষতির হাত থেকে বেঁচেছে মাছের ঘের ও জমির ফসল।
বরিশাল বিভাগে পল্লী বিদ্যুতের ক্ষতি প্রায় ‘তিন কোটি’ টাকা
সিত্রাংয়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসে বরিশাল বিভাগে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
মঙ্গলবার বিকালে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বরিশাল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দীপঙ্কর মন্ডল ও উপ-পরিচালক (কারিগরি) মো. আক্তারুজ্জামান স্বাক্ষরিত ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, বরিশাল জোনের আওতাধীন বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১ ও ২ পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলা সমিতির বিভিন্ন স্থানে ৩৩২টি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে গেছে। এছাড়া ক্রস আর্ম ভেঙেছে ৫৮২টি, টান্সফরমার নষ্ট হয়েছে ১১৯টি, তার ছিঁড়েছে তিন হাজার ৮৩ স্থানে, মিটার নষ্ট হয়েছে এক হাজার ১৭৪টি, ‘ইন্সুলেটর ক্র্যাক’ করেছে ৪৯৫টি।
সরকার যা বলছে
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়ে ওঠা এবং জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি থাকায় সিত্রাংয়ের কারণে যতটা ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, এই ঝড়ে সেরকম কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুর রহমান বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। কারণ ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল ছিল। শুধু বৃষ্টি আর বাতাস বেশি হয়েছে। কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে, জোয়ারের পানি ঢুকেছে আর কিছু মাছের ঘেরে পানি ঢুকেছে।
মোহাম্মদ এনামুর রহমান, প্রতিমন্ত্রী , দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
“ যেভাবে সিত্রাং সৃষ্টি হয়েছিল, যেসব পূর্বাভাস ছিল, যেভাবে এর বিস্তৃতি ছিল এবং যেভাবে সরাসরি বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে এসেছিল, সবাই পূর্বাভাস দিয়েছিল যে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তেমনটি হয়নি। এই সময়ে প্রায় ৬ হাজার ৯২৫ আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদে নিয়ে আসা হয়েছে। ঝড়ে ৪১৯টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং সেখানে প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে” ।
সম্পাদনা- সাজিদ রাজু