সয়াবিন তেল সংকট: মোকাবিলায় করণীয় কী?
আফরিন মিম, ঢাকা: তেল ছাড়াই লালশাক ভাজি করছেন তেজগাঁও রেলগেট বস্তির বাসিন্দা দোলা রানী দাস। গেল তিনদিন তেজগাঁও সমিতি বাজার, নাখালপাড়া কাঁচা বাজার ঘুরে পায়নি কোন সয়াবিন তেল। তাই বাধ্য হয়েই তেল ছাড়াই করছে্ন রান্না।
দোলা রানী দাস চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে জানান, “তিনদিন ধইরা কোন তেল নাই। এর থেইকা ওর থেইকা ধার কইরা আইনা চলি, দোকানেও কোন তেল নাই”।
হঠাৎই দেশের বাজারে ফের সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় একই কথা বলেন বাংলামোটর এলাকার বাসিন্দা শাহীন রিজভী।
তিনি চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে জানান, “কাওরানবাজারের মত বাজারে গিয়েও কোন সয়াবিন তেল পাই নাই। আমি বিশ্বাস করিনা দেশে তেল নাই। ব্যবসায়ীরা তেল মজুদ করে ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মুনাফা লাভের আশায়। এটা খুবই দুঃখজনক।”
ঢাকার বিভিন্ন বাজারের মত সুপারশপ গুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে না সয়াবিন তেল। অনেকেই এসে ফিরেও যাচ্ছেন তেল না পেয়ে।
“দুইদিন মুদির দোকানে ঘুরে কোন সয়াবিন তেল পাইনি। আজকে স্বপ্নে আসলাম, ভাবছি এখানে পাবো। কিন্তু এখানেও তেল না পেয়ে বাসায় চলে যাচ্ছি। হঠাৎ করে এভাবে তেলের দাম বাড়ার পর বাজার থেকে তেল উধাও হয়ে যাবে সেটা ভাবিনি”।
বলছিলেন, ইস্কাটন এলাকার বাসিন্দা সালমা আক্তার।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সংকট দেখা দেওয়ায় দেশের বাজারে ৬ মে থেকে নতুন দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল।
বর্তমানে নতুন দাম অনুযায়ী খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা লিটার, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা, পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল ৯৮৫ টাকা ও পাম তেল ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসাবে পাম তেলের দাম বেড়েছে ২৪%। আর সয়াবিনের দাম খুচরায় বেড়েছে ২৮%, বোতল জাতের ক্ষেত্রে ২৫%।
রমজান শুরুর আগে বাংলাদেশের বাজারে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে সংকট তৈরি হয়েছিল। তখন সরকার হস্তক্ষেপ করে দাম নির্ধারণ করার পর সেই দফায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে।
ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয় করোনার ধাক্কা কাটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধার শুরুর পর থেকে। আর সেই দামের পালে নতুন করে হাওয়া দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কারণ বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের বড় রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন। ফলে সেখানে যুদ্ধের কারণে তেল সরবরাহ হুমকিতে পড়েছে। সারা বিশ্বে রাতারাতি বেড়েছে সূর্যমুখী তেলের দাম।
অন্যদিকে বিশ্বে সয়াবিন তেলের বড় রপ্তানিকারক দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেখানে খরায় এই বছর উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে বিশ্ব বাজারে সয়াবিনের দাম দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে।
এর মধ্যে গত ২২ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়া নিজেদের দেশের বাজারে পামতেলের দাম সহনীয় রাখতে রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে আবারও দাম বেড়ে রেকর্ড হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত দুই মাসে বাড়তে বাড়তে সয়াবিন তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে।
বিশ্ববাজারে তেলের এই সংকট পরিস্থিতি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা মুনাফালাভের জন্য বেছে নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ- এর গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ মাহফুজ কবির।
তিনি চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে জানান, ইন্দোনেশিয়া যখন রপ্তানি বন্ধ করল তার আগেই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা অনেকটাই তেল এনে মজুদ করেছে। তার চিত্র বিভিন্ন অভিযানে উঠে আসছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আগের কেনা তেলের দাম পরিবর্তন করে নতুন দাম দিয়েও বিক্রি করছে বিক্রেতারা।
চলমান এই তেল সংকটে সাধারণ মানুষদের কষ্ট লাঘবে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে তাদের বিক্রি প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখার কথাও বলেন এই তিনি।
তিনি চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে জানান, “টিসিবির কাছে প্রচুর তেল মজুদ আছে। তারা আরও প্রায় তিন কোটি তেল আমদানি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। তারা চাইলেই আগামী ১৬ তারিখ থেকে বিক্রি না করে তাদের বিক্রি স্বাভাবিক রাখতে পারতেন। সেক্ষেত্রে যারা একেবারেই খোলা তেলের উপর নির্ভরশীল তাদের কষ্টটা কমে যেত”।
যেহেতু ব্যবসায়ীরাই মূলত তেল আমদানী করে থাকেন সুতরাং তাদের জন্য শর্ত সহজ করে কিংবা প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার কথাও বলেন তিনি।
প্রতিবেদন – আফরিন মিম
সম্পাদনা- সাজিদ রাজু