বাংলা

মেড ইন চায়না : পর্ব-২১: ছুইওয়ান ও কার্ড খেলা

CMGPublished: 2024-10-19 19:00:35
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

হাজার বছর আগের কাগজ, চা এবং নুডলস থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।

মেড ইন চায়নার ২১তম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার গলফের আদিপুরুষ ছুইওয়ান এবং কার্ড খেলার কথা।

প্রথমেই আমরা শুনবো চীনের আবিষ্কার ছুইওয়ান খেলার কথা। এ খেলা খেলতে চাই দুটো জিনিস। একটি বল ও সেটাকে আঘাত করার জন্য একটা লাঠি। এরপর কাজটা হলো লাঠি দিয়ে আঘাত করে বলটাকে ফেলা চাই একটা গর্তে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ছুইওয়ানের সঙ্গে মিল আছে আধুনিক গলফ খেলার। তাই অনেকের মতে ছুইওয়ানই হলো গলফের আদিপুরুষ। আর এই ছুইওয়ান পুরোপুরি মেড ইন চায়না।

আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগের কথা। চীনে তখন সোং রাজবংশের শাসন চলছে।

ওই সময় ছিলেন ওয়েই তাই নামের এক বিখ্যাত চীনা ইতিহাসবিদ। তোংসুয়ান লু নামে তিনি একটি বই লেখেন। সেই বইতে বর্ণনা করা হয়েছে কী করে দক্ষিণের একজন কর্মকর্তা তার মেয়েকে শিখিয়েছেন মাটিতে গোল করে গর্ত খুঁড়ে তাতে বল ফেলে লক্ষ্যভেদ করতে হয়।

ওয়েই তাইয়ের লেখার কারণে খেলাটি তখন সোং রাজবংশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

চীনের ছুইওয়ান সম্পর্কে জানার জন্য সর্বশেষ নথি ছিল ১৫ শতকের মিং রাজবংশের দুটি চিত্রকর্ম। শানসি প্রদেশের হোংতোংয়ে একটি ওয়াটার গড টেম্পলের দেওয়ালে ম্যুরাল পেইন্টিংয়ে ছুইওয়ান খেলার একটি রঙিন চিত্রকর্ম এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। চীনের লানচৌ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লিং হোংলিন বলেছেন, মধ্যযুগের শেষের দিকে মোঙ্গল পর্যটকরা এ খেলাটিকে ইউরোপ ও পরে স্কটল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিল। আর সেখান থেকেই উৎপত্তি হয় গলফ খেলার।

ছুইওয়ান খেলার নিয়মকানুন কিন্তু এখনকার গলফের মতোই। খেলোয়াড়রা সীমিত সংখ্যক ক্লাব ব্যবহার করতো ছুইওয়ানে। ছুইওয়ানে থাকতো ১০টি ক্লাব ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা আর আধুনিক গলফে আছে ১৪টি। আবার উঁচুনিচু নানা ভূখণ্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে করা হতো গর্ত, এবং সেসব গর্তে পুঁতে দেওয়া হতো রঙিন পতাকা।

ছুইওয়ান খেলার সময় খেলোয়াড়দের সততার ব্যাপারে কঠোর শিষ্টাচার ও নিয়ম মানতে হতো। এমনকি খেলায় কোনো ধরনের অসততার আশ্রয় নিলে ছিল শাস্তির বিধান।

ছুইওয়ানের বল হতো নানা আকারের। আর এগুলো তৈরি হতো কাঠ দিয়ে।

ছুইওয়ান সোং রাজবংশে এতই জনপ্রিয় ছিল যে, সম্রাট হুইচং নিজেও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ খেলোয়াড়। পরবর্তীতে ইউয়ান ও মিং রাজবংশের সময়ও এটি ছিল জনপ্রিয় খেলা। পরে ছিং রাজবংশের সময় ছুইওয়ানের জনপ্রিয়তা কমে আসে এবং ওই সময় শুধু চীনের নারী ও শিশুরা তাদের অবসর কাটাতে খেলাটি খেলতো।

শুনতে সহজ মনে হলেও ছুইওয়ান খেলায় স্কোরিং পদ্ধতিটা ছিল খানিকটা জটিল। পরপর তিনটি বা এর কম স্ট্রোকে গর্তে বল ফেলতে পারলে পাওয়া যেত ৩ পয়েন্টের টোকেন। প্রথম ১০ বা ২০ পয়েন্ট অর্জনকারীকে ঘোষণা করা হতো বিজয়ী। চার বা বেশি স্ট্রোকের জন্য কোনো পয়েন্ট ছিল না।

ছুইওয়ানের সঙ্গে আধুনিক গলফের দুটি বড় মিল হলো গর্তের মাঝে পতাকা ও গলফ ব্যাগ ব্যবহার করা। আবার একটি অমিলও ছিল। ছুইওয়ান খেলায় প্রথম স্ট্রোকটি গলফের মতো সটান দাঁড়িয়ে করা হলেও দ্বিতীয় স্ট্রোকের সময় নিয়ম ছিল খেলোয়াড়কে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসতে হবে।

ছুইওয়ান এখন প্রায় বিলুপ্ত হলেও আদতে গলফের ছদ্মবেশে কিন্তু এটি বেশ বহাল তবিয়তে টিকে আছে। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে নামিদামি খেলার তালিকাতেও আছে এটি।

এবার আমরা শুনবো চীনের আরেকটি আবিষ্কার কার্ড খেলার কথা। ঘরের ভেতর অবসর কাটানোর একটি বড় বিনোদন মাধ্যম হলো নানা ধরনের কার্ড গেইম। আর এই কার্ডের মতো দেখতে যত খেলা আবিষ্কার হয়েছে তারমধ্যে তাস, মাহচোং ও ডোমিনো অন্যতম। কার্ডের এই ইনডোর খেলাগুলো পুরোপুরি মেড ইন চায়না।

ষোড়শ শতকের দিকে মিং রাজবংশের সময়কার লেখক সিয়ে চাওচ্য তার বইতে লিখেছেন, ১১১২ সালে সোং সম্রাট হুইচোংয়ের দরবারে প্রথমবারের মতো কেউ একজন প্রথম চারকোনা টুকরো ধাতব খেলার কার্ড নিয়ে আসেন। তখন থেকে টানা কয়েকশ বছরে ওই কার্ডের তৈরি নানা খেলার উদ্ভব ঘটে।

চীনা ভাষায় কার্ড জাতীয় এ ধরনের খেলাকে বলে পাই। এর মাঝে প্রাচীনতম খেলাটি হলো কু-পাই। যাকে ইংরেজিতে বলে ডোমিনো। বারো শতকের দিকে সোং সম্রাট সিয়াচোংয়ের শাসনামলে চীনের পথেঘাটেও বিক্রি হতো ডোমিনো খেলার টাইল বা ধাতব কার্ড।

এবার প্রাচীন চীনে ডোমিনো বা কার্ড খেলা নিয়ে কিছু তথ্য শোনা যাক

· ডোমিনো খেলার অনেকগুলো ধরন আছে। একেক দেশে একেকভাবে খেলা হলেও সেসব মূলত চীনা ডোমিনো বা পাই কৌয়েরই ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ।

· প্রাচীন চীনে ডোমিনো খেলার কার্ড বানানো হতো কাঠ দিয়ে। কিছু কার্ড বানাতে ব্যবহার করা হতো পশুর হাড়।

· চীনের জনপ্রিয় খেলা মাহচংয়ের উৎপত্তি কু-পাই বা ডোমিনোর হাত ধরে। মাহচং খেলার কিছু কার্ড সরাসরি ডোমিনো থেকেই নেওয়া হয়েছে।

· চীনা ডোমিনো খেলায় ৩২টি টাইল বা কার্ড থাকে। পশ্চিমের খেলায় টাইলের সংখ্যা সাধারণত ২৮টি হয়। চীন থেকে ইউরোপে প্রথম প্লেইং কার্ড নিয়ে যান বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলো।

এরপর কেটে যায় আরও কিছু দিন। পঞ্চদশ শতকে উদ্ভব ঘটে নতুন আরেকটি কার্ড গেইম। যাকে আমরা বলি তাস খেলা। নবম শতকের দিকে ‘শাং’ রাজবংশের প্রথম রাজা থাং সম্রাটের রাজত্বকালে অভিজাত শ্রেণির চীনা নারীরা তাস খেলে সময় কাটাতেন। তখন খেলার কার্ড হিসেবে পয়সা ও এক ধরনের ধাতব প্লেট ব্যবহার করা হতো। পরে সিল্ক রোডের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে চীন থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এই খেলা।

কার্ড জাতীয় খেলাগুলো চীনেই কেন আবিষ্কার হলো? এর পেছনে আছে একটা বড় কারণ। আর তা হলো, চীনেই প্রথম আবিষ্কার হয় কাগজ এবং কাগজের তৈরি মুদ্রা। এ দুটো উপকরণকে বিনোদনের কাজে লাগানোর উপায় ভাবতে গিয়েই তৈরি হয় কার্ড খেলা।

আবার সোং রাজবংশের সময়কার বীর যোদ্ধা ইউয়ে ফেইকে নিয়েও প্রচলিত আছে একটা গল্প। ডোমিনো বা কার্ড খেলাকে জনপ্রিয় করতে তারও নাকি বেশ বড় ভূমিকা ছিল। যুদ্ধের সময় সৈন্যদের বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে তাদের ডোমিনো খেলতে উৎসাহ দিতেন ইউয়ে ফেই।

এই ফাঁকে বলে রাখা যায় যে, কাগজের মুদ্রা দিয়ে কার্ড খেলার সূত্র ধরে প্রাচীন চীনের কিছু কিছু অঞ্চলে দেখা দেয় জুয়ার প্রবণতা। আর মজার এ খেলাগুলোর এমন অপব্যবহার ঠেকাতে চতুর্দশ শতকের দিকেই মিং রাজবংশের প্রশাসন নিষিদ্ধ করে জুয়া খেলা।

গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: নাজমুল হক রাইয়ান

কণ্ঠ: ফয়সল/মিম

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn