মেড ইন চায়না: পর্ব-১১: উডব্লক প্রিন্টিং
হাজার বছর আগের কাগজ, চা এবং নুডলস থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার একাদশ পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার উডব্লক তথা কাঠের তৈরি ব্লক প্রিন্টিংয়ের কথা।
বিশ্ব সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার পেছনে কাগজের গুরুত্ব কতখানি তা আমরা জেনেছিলাম মেড ইন চায়নার প্রথম পর্বে। কিন্তু এই কাগজই শেষ কথা নয়। একটি সভ্যতার অর্জিত যাবতীয় জ্ঞান আরেকটি সভ্যতার হাতে পৌঁছে দিতে সেই কাগজে থাকা চাই ছাপানো তথ্য। এর জন্য দরকার মুদ্রণ প্রযুক্তির। আর বিশ্বের প্রাচীনতম মুদ্রণ কৌশলগুলির একটি হলো উডব্লক প্রিন্টিং। যার মাধ্যমে খোদাই করা কাঠের মধ্যে কালির প্রলেপ দিয়ে তা থেকে প্রিন্ট ও নকশা ছাপানো হয়। আজ থেকে প্রায় ১৪শ বছর আগে চীনের থাং রাজবংশের আমলে ব্যাপকভাবে বই ও বিভিন্ন নকশা তৈরিতে ব্যবহৃত হতো উডব্লক প্রিন্টিং। সেই সূত্রে আধুনিক প্রিন্টিং প্রযুক্তির পূর্বপুরুষ বলা যায় পুরোপুরি মেড ইন চায়না।
কাঠের ওপর খোদাই করে সেটার ওপর রঙের প্রলেপ দিয়ে কাপড়ে নকশা করার পদ্ধতিটা আরও আগের। আজ থেকে আঠারশ বছর আগেও চীনে এ ধরনের নকশা করা কাপড় পাওয়া গেছে। কিন্তু কাগজে কোনও কিছু ছেপে সেটাকে বড় পরিসরে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া, মানে, মোদ্দাকথায় আমরা যেটাকে বই বলেই জানি, সেটা ছাপা শুরু হয় থাং রাজবংশের সময়। আর সপ্তদশ শতকে উডব্লক প্রিন্টিংয়ের স্বর্ণযুগে এভাবেই ছাপচিত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বই ও নথিপত্র তৈরির জনপ্রিয়তা।
কেমন করে এলো উডব্লক প্রিন্টিং? এ নিয়ে সরাসরি কোনো আবিষ্কর্তার নাম না পাওয়া গেলেও যথারীতি একটি গল্প আছে।
চীনের একটি প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থের নাম ছি শু। ইংরেজিতে যাকে বলে বুক অব ছি। লিয়াং রাজবংশের সময়কালে ৪৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৫০২ সাল পর্যন্ত এই বইটি লিখেছিলেন প্রাচীন চীনা ইতিহাসবিদ সিয়াও চিসিয়ান। সেই বইতে উল্লেখ করা হয়েছে কং সুয়ান-ই নামের এক লোকের কথা। যার ভাষ্য হলো, তাকে এক অতিমানবীয় প্রাণী এসে একটা জেড পাথর দেয়। যে পাথর কাগজের ওপর চাপ দিলেই ফুটে উঠে এক রহস্যময় ছবি। কং সেই জেড পাথর দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় গভর্নরকে। এমনকি তিনি নাকি এ পাথর দিয়ে কাগজে ছাপচিত্র তৈরি করে সেটাকে জাদু হিসেবে উপস্থাপন করতেন সবার সামনে।
ইতিহাসবিদরা অবশ্য সেই জেড পাথরকে জাদুকরি কিছু নয়, বরং বিশ্বের প্রথম ব্লক প্রিন্টারই বলছেন। আর ঠিক ওই ধরনের ছাপচিত্র দেখা যায় আড়াই হাজার বছর আগের হান রাজবংশের সময়কার সিল্কের কাপড়েও। তখন অবশ্য কাপড়ে ফুলের নকশা তৈরিতেই ব্যবহার করা হতো পাথরের ব্লক।
সপ্তদশ শতকে চীনের উডব্লক প্রিন্ট পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে একটি বড় ভূমিকা রাখেন মহাযান নামের বুদ্ধিজমের একটি শাখা। ওই সময় বুদ্ধিস্টরা তাদের নানা মন্ত্র ও তথ্য ছড়িয়ে দিতে এই উডব্লক প্রিন্টিং পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। ওেই সময় কাগজের স্ক্রলে তারা ব্লক প্রিন্ট করে তৈরি করেছিলেন বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্রাকৃতির স্ক্রল বা রোল করা মন্ত্র ছাপানো কাগজ, যে কাগজগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ধরনী নামে। ১৯৭৪ সালে ওই ধরনীর একটি অংশ পাওয়া গিয়েছিল চীনের শায়ানসি প্রদেশের সি’আনের একটি সমাধিতে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানালেন, স্ক্রলগুলো ছাপা হয়েছিল থাং রাজবংশের আমলে। সেই সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল স্বধর্ম পুন্দরিকা সূত্র নামে একই ধরনের আরেকটি স্ক্রল। উডব্লক পদ্ধতিতে যা ছাপা হয়েছিল ৬৯০ থেকে ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে।
চীন থেকে কী করে ছড়িয়ে পড়লো উডব্লক প্রিন্টিং? চলুন সেটা শোনা যাক শান্তা মারিয়ার কাছ থেকে
চীনে উডব্লক প্রিন্টিং জনপ্রিয় হওয়ার পরপরই এ পদ্ধতির কথা জানতে পারে কোরিয়া ও জাপানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। ১৯৬৬ সালে আজকের দক্ষিণ কোরিয়ায় আবিষ্কার হয় দ্য গ্রেট ধরনি সূত্র’র কিছু স্ক্রল। পরীক্ষায় দেখা যায়, সেগুলো উডব্লক প্রিন্টিং পদ্ধতিতে ছাপা হয়েছিল ৭০৪ থেকে ৭৫১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ৮ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৬৩০ সেন্টিমিটার লম্বা স্ক্রলগুলো তুঁত কাগজের ওপর মুদ্রিত ছিল। পরে জাপানে পাওয়া যায় ৭৭০ সালে ছাপা হওয়া ধরণী সূত্রের বেশ কিছু মুদ্রিত কপি। জানা যায়, ওই সময়কার জাপানি সম্রাজ্ঞী শোতোকু ওই মন্ত্রগুলোর ১০ লাখ কপি তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। অনুলিপিগুলো একটি ছোট কাঠের প্যাগোডায় সংরক্ষণ করা হয়েছিল। জাপানে এগুলো একসঙ্গে হাইকুমান্তো দারানি নামে পরিচিত।
পরে এক হাজার খ্রিস্টাব্দের দিকে উডব্লক প্রিন্টিং ছড়িয়ে পড়ে ইউরেশিয়াজুড়ে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেও তৈরি হলো বেশ কিছু নথি। ১৩০০ সালের দিকে, অর্থাৎ চীনে ব্যাপক হারে প্রচলনের ছয়শ বছর পরে উডব্লক প্রিন্টিংয়ের কথা জানতে পারে ইউরোপে। ওই সময় কাপড়ে এ ধরনের মুদ্রণ করতে শুরু করে ইউরোপীয়রা।
৯৩২ থেকে ৯৫৫ সাল নাগাদ চীনের সোং রাজবংশের আমলে উডব্লক প্রিন্টিংয়ে ছাপা হতে শুরু করে চীনা ক্লাসিক গল্প। তখন চীনের বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাসিক বইগুলো এ পদ্ধতিতে ছাপিয়ে বিতরণ করা হতো শিক্ষার্থীদের মাঝে। ধ্রুপদী সাহিত্যের পাশাপাশি ওই সময় উডব্লকে ছাপা হয় ইতিহাস, দর্শন, এনসাইক্লোপিডিয়া এমনকি যুদ্ধকৌশল ও ভেষজ ওষুধ সংক্রান্ত বইও।
৯৭১ সালে উডব্লক প্রিন্টিংয়ে চীনের ছেংতুতে ছাপানো শুরু হয় বৌদ্ধদের পবিত্র গ্রন্থ ত্রিপিটক। এর জন্য এক লাখ ৩০ হাজার ব্লক তৈরিতে সময় লেগেছিল টানা ১০ বছর। ৯৮৩ সালে গ্রন্থটির সিছুয়ান সংস্করণও প্রকাশ হয়। যার নাম রাখা হয় খাইবাও ত্রিপিটক।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে আমরা আবার শান্তা মারিয়ার কাছ থেকে শুনবো, মুদ্রণের জগতে কী কী পরিবর্তন এলো চীনের আবিষ্কার উডব্লক প্রিন্টিং
আগে গুরুত্বপূর্ণ লেখা-আঁকা ছাপা হতো স্ক্রল বা গোল করে পাকানো কাগজে। সেটা চওড়ায় ছোট হলেও দৈর্ঘ্য হতো বেশ লম্বা। উডব্লক প্রিন্টিং আসার পর থেকে চারকোণা কাগজে ছাপানো শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে যা আজকের বইয়ের রূপ ধারণ করে।
এক হাজার সালের দিকে একই কাগজের এপিঠ-ওপিঠে ছাপানো হয় লেখা। উডব্লকের কারণেই যা সম্ভব হয়েছে। এতে করে সাশ্রয় হলো অনেক কাগজ।
কাঠের ব্লকের প্রিন্টিংয়ের কারণে প্রাচীন চীনে পাণ্ডুলিপি তৈরির খরচ প্রায় দশ ভাগের এক ভাগে নেমে আসে।
চীনের উত্তরাঞ্চলে কাঠের তৈরি প্রতিস্থাপনযোগ্য টাইপ আবিষ্কার হয় ১০৪১ সালে সোং রাজবংশের আমলে। আর ধাতব টাইপ আবিষ্কার হয় দক্ষিণাঞ্চলে।
হান রাজবংশের আমলে সিল্কের ওপর উডব্লক প্রিন্টিং পদ্ধতিতে প্রথম রঙিন নকশা প্রিন্ট করা হলেও মুভেবল টাইপ পদ্ধতিতে প্রথম রঙিন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১৬০৬ সাল পর্যন্ত। চীনে তৈরি ওই বইটির নাম ছেংশি মোইয়ুয়ান। এরপরই রং-বেরঙের ছাপচিত্র তৈরির পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এমনকি তিন-চারশ বছরের পুরনো সেই সব প্রাণবন্ত রঙিন ছাপচিত্র এখনও বিক্রি হতে দেখা যায় অনলাইনে।
সুপ্রিয় শ্রোতা, আজকের মেড ইন চায়না ছিল এ পর্যন্তই। আগামী সপ্তাহে আবার ফিরবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কারের গল্প নিয়ে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: নাজমুল হক রাইয়ান
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী