বাংলা

মেড ইন চায়না: পর্ব-৯: চীনামাটি

CMGPublished: 2024-07-27 15:52:24
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

হাজার বছর আগের কাগজ ও চা থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।

মেড ইন চায়নার নবম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার চীনামাটির কথা।

সময়ের ছাপ পড়ে সব কিছুতেই। সময় যত যায়, ততই বিলীন হয় জৌলুস, হারিয়ে যায় আবেদন। তবে একটা বস্তু আছে যা হাজার বছরেও থাকে চকচকে। ঠিকঠাক যত্নআত্তি পেলে যাতে একটুও ফাটল ধরবে না। বলছিলাম, চীনের অন্যতম ঐতিহ্য চীনামাটির তৈযশপত্রের কথা। হাজার বছর ধরে যে চীনামাটিতে একতরফা আধিপত্য ধরে রেখেছে চীন। চীনামাটি মানেই মেড ইন চায়না।

চীনের ঐতিহ্যের কথা ভাবলেই মাথায় আসে চীনামাটির দারুণ সব তৈযশপত্রের ছবি। রাজসিক একটি পণ্য এই চীনামাটির। তাই যে দেশই হোক না কেন প্রাচীন রাজদরবার থেকে শুরু করে আজকের জাদুঘরেও চীনের চীনামাটির পণ্য থাকা চাই।

তবে এক দিনে বা একক কোনো ব্যক্তি এই চীনামাটি আবিষ্কার করেননি। আজ থেকে দুই হাজার বছরেরও আগে থেকে শুরু হয় চীনামাটি তৈরির প্রক্রিয়া। এরপর কয়েক শতাব্দি ধরে বিকশিত হতে থাকে পোরসেলিন ওরফে চীনামাটি। দিনে দিনে এটি হতে থাকে আরও টেকসই ও দৃষ্টিনন্দন।

চীনামাটির জিনিসপত্র তৈরি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগে এর ইতিহাসটা জানিয়ে রাখি সংক্ষেপে।

২৩ সাল থেকে ২২০ সাল পর্যন্ত হান রাজবংশের আমলে চীনামাটির তৈযশপত্রের সূত্রপাত ঘটে চীনে । প্রথমে দক্ষিণাঞ্চলে ও তারপর চীনের উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে বেশ অগ্রগতি অর্জন করে চীনামাটি। দশম শতাব্দী থেকে এয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিক পর্যন্ত থাং ও সুং রাজবংশের আমলে চীনামাটির পাত্র তৈরির পদ্ধতি আরও বিকশিত হয়। এই সময়কালে তৈরি রঙিন চীনামাটির বাসনে ঐতিহাসিক চাইনিজ পেন্টিং ও খোদাইকর্মের ব্যবহার দেখা যায়।

১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী মিং রাজবংশ এবং ১৬৪৪ থেকে ১৯১১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিং রাজবংশের আমল ছিল চীনামাটির পাত্র তৈরির স্বর্ণযুগ । এই যুগে তৈরী চীনামাটির পাত্রের সংখ্যা আর গুণগত মান ছিল অন্য সব সময়ের চেয়ে বেশি।

চীনের দক্ষিণাঞ্চলের চিন তে চেন শহরকে বলা হয় "চীনামাটির রাজধানী"। এটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কয়েকশো বছর স্থায়ী হওয়া মিং ও ছিং রাজবংশের আমলে চীনামাটির পাত্রের জগতে এ শহরই ছিল অগ্রপথিক। এখন পর্যন্ত চীনের সবচেয়ে দামি চীনামাটির পাত্রগুলো তৈরি হয় চিনতে চেন শহরেই।

এবার চীনামাটির বাসনকোসন তৈরির কারিগরি দিক নিয়ে জানা যাক।

চীনামাটির কাঁচামাল হলো কাওলিন নামের একটি প্রাকৃতিক খনিজযুক্ত পদার্থ। এই পদার্থটিকে নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়ার পর বড় আকারের চুল্লিতে ১২০০ ডিগ্রি থেকে ১৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পুড়িয়ে তৈরি করা হয় চীনামাটির নানা পণ্য । কাওলিন সংগ্রহ করার পর সেটাকে পরিষ্কার ও চূর্ণ করার পর তাপ দেওয়ার আগে ও পরে রয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। প্রাথমিক আকৃতি দেওয়ার পর প্রথম ধাপে একবার প্রচণ্ড তাপ দেওয়া হয়। পরে নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপেও তাপ দেওয়া হয়।

চীনের চিয়াংশি প্রদেশের চিনতেচেন শহরের কাওলিন গ্রামের একটি টিলা থেকে এ মাটি সংগ্রহ করা হয় বলেই মূলত ওই খনিজের আরেক নাম কাওলিন। এই কাওলিনে আছে ৪৬ শতাংশ বালু, ৪০ শতাংশ অ্যালুমিনা ও ১৪ শতাংশ পানি।

উচ্চ তাপমাত্রায় পোড়ানোর ফলে চীনামাটির ভেতরে মালাইট নামের একটি খনিজ গঠিত হয় এবং মাটির ভেতর কাচিভবন নামের একটি প্রক্রিয়া ঘটে। এতে করে মৃৎশিল্পে ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানের তুলনায় চীনামাটি বেশি শক্ত, ভারবাহী ও স্বচ্ছ হয়ে থাকে। চীনামাটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি অভেদ্য। এর ভেতর দিয়ে পানি প্রবেশ করতে পারে না বলে এটি হাজার বছর ধরে টিকে থাকে।

এই ফাঁকে জেনে নেওয়া যাক চীনামাটি নিয়ে কয়েকটি তথ্য

· এশিয়ায় বরাবরই চীনের চীনামাটির পাত্র রফতানি হতো। সপ্তদশ শতাব্দিতে পশ্চিম ইউরোপের রাজদরবারেও চীনামাটি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। এ সময় চীনামাটির পাত্র ইউরোপীয় সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান উপহারে পরিণত হয়।

· এক হিসাবে দেখা গেছে সপ্তদশ শতাব্দীতে চীন প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ চীনামাটির পাত্র রফতানি করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বছর সর্বোচ্চ প্রায় দশ লক্ষ চীনামাটির পাত্র রফতানি করার রেকর্ডও আছে চীনের।

· হাজার বছর আগেই চীন থেকে চীনামাটি রপ্তানি হতে শুরু করে পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে। মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীনকালে চীন থেকে চীনামাটির পণ্য এত বেশি রপ্তানি হতো এবং এগুলো এতই জনপ্রিয় ছিল যে, অনেক দেশের মানুষ এখনও চীনামাটির জিনিসপত্রকে ‘চায়না’ নামেই ডাকে।

·

· এটি বলা বাহুল্য যে, বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি চীনামাটির পণ্য রপ্তানি করে চীন। সারাবিশ্বে ২০২২ সালে চীন থেকে চীনামাটির তৈযশপত্র রপ্তানি হয়েছিল প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের।

ষোড়শ শতক থেকেই চীনের পোরসেলিন যেতে শুরু করে ইউরোপে। পরে উত্তর আমেরিকাতেও গড়ে ওঠে এর বাজার। ওই সময় মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে চীনামাটির তৈযশপত্রের কদর বাড়ে অনেক। আরব দেশগুলোর সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে ওই সময় চওড়া আকারের পাত্র তৈরি করতে শুরু করে চীনা কারিগররা। পর্তুগিজ বণিকরাই প্রথম মিং রাজবংশের আমলে চীনের সবচেয়ে দামি নীল ও সাদা রঙের চীনামাটির তৈযশপত্র আমদানি করে ইউরোপে।

চলুন শোনা যাক চীনামাটি নিয়ে আরও কয়েকটি তথ্য

· চীনের পোরসেলিন বা চীনামাটির জনপ্রিয়তার কারণে সপ্তদশ শতকের দিকে অনেক বিখ্যাত চিত্রকরের পেইন্টিংয়ে দেখা যায় চীনামাটির জিনিসপত্র, বিশেষ করে ফুলদানি ও পাত্রের ছবি।

· বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন লাইনে ইনসুলেটর হিসেবে চীনামাটি ব্যবহার করা হয়। কারণ চীনামাটি বেশ ভালো বিদ্যুৎ রোধক হিসেবে কাজ করে।

· চীন থেকে চীনামাটির কদর ইউরোপে পৌঁছায় অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে। কাওলিন খনিজটি হাতে পেলেও তখন ইউরোপের মৃৎশিল্প কারিগররা চীনামাটির জিনিসপত্র তৈরি করতে পারতেন না। তাই দীর্ঘসময় চীনামাটির বাসনকোসন তৈরির প্রক্রিয়া শিখতে তাদের আসা-যাওয়া করতে হয়েছে চীনে।

· চীনামাটি স্বাস্থ্যসম্মত। সাধারণ পাথরের চেয়ে চীনামাটির স্ল্যাবে খাবার প্রস্তুত করা তাই অধিক নিরাপদ।

চীনামাটির সঙ্গে চীনের প্রাচীন ইতিহাসের সম্পর্কটা বেশ গভীর। এ কারণে চীনের প্রাচীন চীনামাটির জিনিসপত্রের মধ্যে দেওয়া থাকে সেটা কোন রাজবংশের আমলে তৈরি হয়েছিল সেই তথ্য বা সীল মোহর। আবার চীনামাটির সঙ্গে ঐতিহ্যের সম্পর্ক এতটাই যে, অনেক সময় প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটেও পাওয়া যায় ভাঙা চীনামাটির টুকরো। তখন সেই ভাঙা টুকরোটিও বেশ যত্ন করে রাখা হয় জাদুঘরে।

গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দ

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn