বাংলা

মেড ইন চায়না: পর্ব-৮: ছুচু খেলা

CMGPublished: 2024-07-27 15:49:55
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

হাজার বছর আগের কাগজ ও চা থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।

মেড ইন চায়নার অষ্টম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ... আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার বল খেলার কথা।

এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। হাওয়াভর্তি গোলগাল একটা বস্তুর পেছনে ২২ জন খেলোয়াড়ের ছুটে চলার এ খেলা নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। নানা সময়ে নানা নিয়মকানুনের হাত ধরে আজকের ফুটবল পেয়েছে তার আধুনিক রূপ। তাই ফুটবলের আবিষ্কার কারা করলো তা নিয়ে নানা মুনির আছে নানা মত। তবে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই চীনের হান রাজবংশের সময় পাখির পালকভর্তি গোলাকার বলকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ছুঁড়ে ফেলার একটা খেলা ছিল। যার নাম ছিল ছুচু। ওই সময় এমন নিয়মও ছিল যে, বলটিকে পা দিয়েই খেলতে হবে, কিছুতেই হাত দিয়ে ধরা যাবে না। এমনকি এ খেলায় ছিল একটা গোলপোস্টও। অর্থাৎ আধুনিক ফুটবল খেলার ভিত্তিটা রচনা হয়েছিল ওই হান রাজবংশের আমলে, ছুচুর হাত ধরে। পা দিয়ে বল ছোড়াছুড়ির ছুচু খেলাটাকে বিশ্বের প্রাচীনতম বল খেলার স্বীকৃতি দিয়েছে স্বয়ং ফিফা। সুতরাং এটা বলাই যায়, ফুটবলের পূর্বপুরুষ আপাদমস্তক মেড ইন চায়না।

চীনে শুরুর দিকে ছুচু খেলাটি সবার জন্য ছিল না। এটি খেলা হতো শরীরচর্চার অংশ হিসেবে। ওই সময় চীনের সৈন্যসামন্তরাই ছুচু খেলতো বেশি। পরে তাদের মধ্যে খেলাটি এত বেশি জনপ্রিয়তা পায় যে ধীরে ধীরে রাজদরবার ও উচ্চপদস্থ লোকেরাও খেলতে শুরু করে ছুচু।

চলুন শোনা যাক ছুচু নিয়ে কয়েকটি তথ্য

বলা হয়ে থাকে হান সম্রাট উ তি নিজেও খেলেছেন ছুচু তথা বল খেলা। তার সময়ই ছুচু খেলার কিছু নিয়ম তৈরি করা হয়। এমনকি রাজ প্রাসাদের ভেতর ছুচু খেলার জন্য নির্ধারিত মাঠও ছিল।

ছুচু খেলার মাঠের নাম চু ছাং। এখনকার ফুটবল মাঠে দুই প্রান্তে দুটো গোলপোস্ট থাকলেও ছুচু খেলায় মাঠের মাঝে থাকতো অর্ধচন্দ্রাকৃতির গোলপোস্ট।

ছয়শ থেকে নয়শ সালে থাং রাজবংশের শাসনামলে ছুচু খেলার বলের ভেতর পাখির পালকের বদলে ঢোকানো হয় বাতাস। এতে করে বলে কিক দেওয়ার কাজটা হয়ে যায় আরও সহজ। ছুচুর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় আরেক দফা। চীনের আরও অনেক স্থানে তৈরি হতে থাকে বল খেলার মাঠ।

থাং রাজবংশের সময়ই চীনে চালু হয় নারীদের ছুচু দল। ওই সময় চীনের বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরাও খেলতেন মজার এই বল খেলা।

চীনের আবিষ্কার ছুচুর দেখাদেখিই মূলত বল জাতীয় আরও অনেক খেলা আবিষ্কার হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাপানের কেমারি। ছুচু খেলারই আরেক নাম বলা যায় একে। কেমারি খেলার বলটি তৈরি করা হতো হরিণের চামড়া দিয়ে, আর বলের ভেতর থাকতো বার্লি দানা।

ছুচু তথা আজকের ফুটবলের আদিপুরুষ এ খেলার মূল উত্থানটি ঘটে মূলত সোং রাজবংশের আমলে। ৯৬০ থেকে ১২৭৯ সাল পর্যন্ত টিকে থাকা এ রাজবংশের সময় চীনের সকল শ্রেণির মানুষই খেলতে শুরু করে ছুচু। তখন তারকা ছুচু খেলোয়াড়ও ছিল চীনে। এমনকি এখনকার বড় বড় ক্রীড়া আসরের মতো বাণিজি্যকভাবেও আয়োজন করা হতো ছুচু খেলার।

এই ছুচু কিন্তু শুধু খেলা ছিল না। এটা যে চীনাদের জীবনের একটা অন্যতম অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন চীনের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মেও। হান রাজবংশের সময়কার বিখ্যাত কবি লি ইউ তার কবিতায় ছুচুকে তুলনা করেছিলেন উন্নত জীবনযাপনের একটি উপকরণ হিসেবে।

তবে তেরোশ থেকে ষোলোশ’ সালের দিকে মিং রাজবংশের সময় ছুচু খেলার চল ধীরে ধীরে কমতে থাকে। পরে বল জাতীয় আরও অনেক নতুন খেলার আবির্ভাবের পর ছুচু খেলাটি বলতে গেলে হারিয়েই যায়।

কেমন করে খেলা হতো ছুচু?

এখনকার ছুচু খেলা দেখে ভলিবলের কথা মাথায় আসবে আগে। তবে পার্থক্য হলো, শরীরের যে অংশই ব্যবহার করা হোক না কেন, এ খেলায় বলটিতেহাত লাগানো যাবে না কিছুতেই। প্রতিযোগিতামূলকভাবে যেমন খেলা যায় তেমনি সবাই মিলে বিনোদনের ধাঁচেও খেলা যায় ছুচু। হাওয়া বা পালক ভর্তি চামড়ার একটি বলকে শুধু পা দিয়ে কে কতটা সূক্ষ্ম ও চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, সেটার ওপর নির্ভর করে কে কত দক্ষ ছুচু খেলোয়াড় হবে। আর ছুচু খেলায় কেউ পারদর্শী হলে তাকে বলা হতো সিয়েশু।

এখনও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে চীনে ও অন্যান্য দেশে যে ছুচু খেলা হয় তা অনেকটা এমন। একটি মাঝারি আকারের মাঠের ঠিক মাঝে রাখা হয় গোল পোস্ট। বাস্কেট বলের পোস্টের মতো ছুচু খেলার পোস্টটাও থাকবে বেশ কিছুটা উঁচুতে। বেশ খানিকটা উঁচুতে থাকা ওই পোস্টের ঠিক মাঝে থাকবে দুই ফুট ব্যাসের গোলাকার একটি গর্ত। যাকে বলা হয় চোখ। সেই চোখের ভেতর দিয়েই এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাঠে বলটাকে ছুড়ে দেয়। তবে শর্ত হলো বলটাকে হাত দিয়ে ধরা যাবে না, আবার বলটা মাটিও স্পর্শ করতে পারবে না। দুই পাশে পাঁচ বা ছয় কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে দশ জন করেও খেলোয়াড় থাকে। যে পক্ষ বল নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে মাটিতে ফেলে দেবে, তারাই হারাবে পয়েন্ট।

অর্থাৎ ছুচুর মূল দক্ষতা হলো বলটাকে মাটিতে না ফেলে কাঠের গর্ত দিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে পার করা। গর্ত দিয়ে বল ঠিকঠাক পার করতে পারলেই মিলবে পয়েন্ট। এই অর্থে ছুচুকে ভলিবল বা বাস্কেটবলের পূর্বপুরুষ বললেও ভুল হবে না।

থাং রাজবংশের সময় ছুচুর বল তৈরিতে ব্যবহার করা হতো দুই টুকরো চামড়া। সেলাই করে সেটাকে দেওয়া হতো বলের আকৃতি। চূড়ান্ত সেলাইয়ের আগে বলটার ভেতর বেশি করে পুরে দেওয়া হতো পাখির পালক। এর অনেক অনেক দিন পর আট টুকরো চামড়া সেলাই করে তৈরি হতে লাগলো ছুচুর বল। পরে সোং রাজবংশের সময় ছুচুর বল তৈরি হতো ১২ টুকরো চামড়া দিয়ে। একটি বলের ওজন হতো প্রায় ৬০০ গ্রাম।

ছুচু খেলার সঙ্গে এখনকার যে খেলার সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যাবে তা হলো ফ্রিস্টাইল ফুটবল। বলের গায়ে হাত না দিয়ে পায়ে পায়ে রেখে নানা কসরত দেখানোই যে খেলার বড় কৃতিত্ব। প্রাচীন বলে এখন ছুচু খেলা যাবে না, এমন কথা কিন্তু নেই। ফিফা মিউজিয়াম ডট কম বলছে, নিয়ম করে ছুচু খেললে স্বাস্থ্য থাকবে ভালো। শরীর ও মন দুটোই একযোগে খাটাতে হয় এ খেলায়। তাই মানসিক অবসাদও কাটাতে পারে এ খেলা।

গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn