মেড ইন চায়না পর্ব-৪ ছাতা
মেড ইন চায়না
পর্ব-৪
বিষয়: ছাতা
হাজার বছর আগের কাগজ থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী এসব আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার চতুর্থ পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ। আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার ছাতার গল্প।
আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কথা। চীনে তখন চলছিল চৌ রাজবংশের শাসন। লু বান ওরফে মাস্টার লু ছিলেন ওই সময়কার একজন স্থপতি, প্রকৌশলী ও আবিষ্কর্তা। নির্মাণশিল্পে তাকে এখনও রীতিমতো গুরু হিসেবে বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করে চীনারা। কিন্তু, না... লু বান ছাতা আবিষ্কার করেননি। করেছিলেন তার স্ত্রী। লু বানের স্ত্রীর নাম ইতিহাসে খুব একটা আসেনি। তাই নাম নিয়ে আছে কিছুটা বিভ্রান্তি। তবে কয়েকটি সূত্রে দেখা গেছে ছাতার আবিষ্কারক লুবানের স্ত্রীর নাম ইউননিয়াং ওরফে ইউন।
ছাতা আবিষ্কারের আইডিয়া কী করে পেলেন ইউন? এ নিয়ে প্রচলিত আছে তিনটি গল্প। প্রথমত, কাঠের আসবাবপত্র ও নানা ধরনের জিনিসপত্র বানাতে দিনরাত কাজ করতেন লু বান। স্বামীর এমন কষ্ট দেখে প্রিয়তমা স্ত্রী ভাবলেন তাকে ছায়া দেওয়ার জন্য একটা কিছু বানানো দরকার, এমন চিন্তা থেকেই প্রথম ছাতার আইডিয়া পান ইউন।
আরেকটা গল্প হলো, একবার বৃষ্টিতে লু বান ও ইউন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা তাঁবুতে। তখনও আবিষ্কার হয়নি ছাতা। তাই বৃষ্টি মানেই ছিল দারুণ যন্ত্রণা। তখন তাঁবুর নিচে বসে লু বান কিংবা অন্য কেউ বলেছিলেন, আস্ত তাঁবুটাকে নিয়ে হাঁটাচলা করতে পারলেই তো বৃষ্টি নিয়ে আর চিন্তা করতে হতো না। এ কথা শুনেই ইউনের মাথায় এলো ছাতার আইডিয়া।
তিন নম্বর গল্পটা হলো, বৃষ্টির মধ্যে একদল শিশুকে দেখেন ইউন। বৃষ্টিতে মাথা যেন না ভেজে এ জন্য ওই শিশুদের হাতে ছিল উল্টো করে ধরে রাখা পদ্মপাতা। ইউন ভাবলেন, এক টুকরো কাপড়কে একটা কাঠামোর মধ্যে আটকে দিলেই কাজটা সহজ হয়ে যায়। পদ্মপাতার মতো বারবার আর ছাউনিটা বদলাতে হবে না।
মূলত মাথা ঢেকে বৃষ্টি বা রোদ আটকে দিলেই কিন্তু সেটা ছাতা হয়ে যায় না। ইউনের মূল আবিষ্কারটা ছিল মূলত ছাতার কাঠামো তৈরি এবং পানিরোধক বস্তু দিয়ে এমনভাবে বানানো যাতে করে সেটাকে নিয়ে সহজে চলাফেরা করা যায়। মজার ব্যাপার হলো, সাড়ে তিন হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও সুপ্রাচীন চীনে তৈরি ছাতার কাঠামোটা কিন্তু আগের মতোই আছে।
অনুষ্ঠানের এই ফাঁকে ছাতা নিয়ে দুটি মজার তথ্য জেনে রাখুন
চীনে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আবিষ্কার হলেও ইউরোপে ছাতার ব্যবহার শুরু হয় আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু ওই সময় ছাতা শুধু ইউরোপীয় নারীদের হাতেই দেখা যেত। এমনকি ওই সময় অভিধানেও ছাতা তথা আমব্রেলার অর্থ লিখতে গিয়ে বলা হয়েছে, এটি কাপড়ের তৈরি এমন এক বস্তু যা নারীরা ব্যবহার করে। পরে ১৭৫০ সালের দিকে লন্ডনের লেখক জোনাস হানওয়ে প্রথম ইউরোপীয় পুরুষ হিসেবে ছাতা ব্যবহার করতে শুরু করেন। মূলত তার দেখাদেখিই পরে অন্য ইংরেজ পুরুষরাও একযোগে ব্যবহার করতে শুরু করে ছাতা।
প্রথম দিকে চীনে ছাতা তৈরিতে রেশম ব্যবহার করা হলেও পরে এতে যুক্ত হয় কাগজ। এতে করে ছাতার দাম চলে আসে সাধারণ চীনাদের হাতের নাগালে। রোদে ক্ষতি না হলেও পানিতে কাগজ নষ্ট হয়ে যাবে বলে তাতে লাগানো হয় তেলের একটি আস্তর। আর এভাবেই আবিষ্কৃত হলো অয়েল পেপারে তৈরি বিশ্বের প্রথম ওয়াটারপ্রুফ ছাতা। অবশ্য এখনকার ছাতাগুলোকে পানিরোধক করতে আর তেল নয়, ব্যবহার করা হয় টেফলন নামের একটি রাসায়নিকের প্রলেপ।
চীনের সংস্কৃতিতে ছাতার গুরুত্ব অনেক। আবিষ্কারের পর দিনে দিনে ছাতা হয়ে ওঠে আভিজাত্য ও গৌরবের প্রতীক। চীনের বিভিন্ন রাজবংশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের হাতে দেখা যেত ছাতা। এমনকি প্রাচীন চীনের চিত্রকলায় ছাতার রং দেখেও বোঝা যেত কোন ছবিটি কোন রাজবংশের। ওয়েই রাজবংশের শেষের দিকে চীনে নানা ধরনের সরকারি অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হতো ছাতা। ওটাকে বলা হতো লুও ছাতা। এই লুও ছাতাই হয়ে যায় রাজবংশের নানা পদমর্যাদার প্রতীক। তবে পদমর্যাদা অনুযায়ী ছাতার রং হতো ভিন্ন। যেমন হান রাজবংশের তিন নম্বর র্যাংকের ওপরে থাকা কর্মকর্তারা ব্যবহার করতেন সবুজ রঙের ছাতা। আবার সোং রাজবংশের সম্রাটদের হাতে দেখা যেত হলুদ ও লাল রঙের ছাতা।
প্রাচীন চীনে তুঁতের ছাল এবং বাঁশের ফ্রেম থেকে তৈরি করা হতো ছাতা। তবে যেনতেন বাঁশ হলে চলতো না। এর জন্য চাই অন্তত পাঁচ বছরের পুরোনো বাঁশ। সিল্ক দিয়ে যে দামি ছাতা তৈরি হতো তাতে নকশা করার জন্য ডাক পড়তো চীনের শিল্পীদের। তারা তাতে ড্রাগন, প্রকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, ও পৌরাণিক নানা গল্প ফুটিয়ে তুলতেন। এখন চীনের ঐতিহ্যবাহী ছাতার দোকানগুলো এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে ছাতা নিয়ে শোনা যাক আরও কয়েকটা মজার তথ্য
•বিশ্বে বছরে প্রায় ১১০ কোটি ছাতা বিক্রি হয়। এর ৮০ ভাগই তৈরি হয় চীনে। পূর্ব চীনের ফুচিয়ানে আছে তোংশি নামের একটি শহর। তোংশি শব্দটির অর্থই হলো ছাতার টাউন। কারণ চীনে যত ছাতা তৈরি হয় তার তিন ভাগের এক ভাগই তৈরি হয় তোংশিতে।
•চীনে সাধারণ ছাতা তৈরিতেই পার করতে হয় অনেক সূক্ষ্ম ধাপ। মোট ৮০টি ধাপে তৈরি করতে হয় একটি হ্যান্ডমেইড ছাতা।
•চীনা উপকথায় ছাতা হলো নিরাপত্তার প্রতীক। তবে উপহার হিসেবে কিন্তু ছাতা সেখানে মোটেও কাম্য নয়। কারণ চীনে কেউ কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলে তাকে ছাতা উপহার দেয়।
•প্রাচীন চীনের অভিজাত কিংবা রাজবংশের লোকেরা হলুদ ও লাল রঙের ছাতা ব্যবহার করতেন আর সাধারণ জনগণ ব্যবহার করতেন নীল রঙের ছাতা।
ছাতা আবিষ্কার করেই কিন্তু বসে থাকেনি চীনারা। ছাতার ভেতর সর্বাধুনিক সোলার প্রযুক্তির ব্যবহারটাও কিন্তু চীনের হাত দিয়ে শুরু হয়। বেইজিংয়ের প্রতিষ্ঠান হ্যানার্জি গ্রুপ তৈরি করে পাতলা সোলার ফিলম্। আর সেই ফিল্ম বসিয়ে তারা তৈরি করেছে বিশেষ সোলার ছাতা।
এতে যে বিদ্যুৎ জমা হবে তা থেকে ফোন বা অন্যান্য ডিভাইস চার্জ দেওয়া যাবে। আর এ কাজের জন্য ছাতাটির মাঝ বরাবর রাখা হয়েছে চারটি ইউএসবি পোর্ট। হ্যানার্জি কোম্পানির দেখাদেখি চীনের আরও কিছু প্রতিষ্ঠানও এখন তৈরি করছে বহনযোগ্য সোলার ছাতা। চলতে চলতেই যে ছাতা চার্জ দেবে আপনার সেলফোন বা অন্য কোনো ডিভাইসকে।
সুপ্রিয় শ্রোতা আজকের মেড ইন চায়না ছিল এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে আবার আসবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কারের গল্প নিয়ে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী