চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-৪৩
১. সংস্কৃতি সপ্তাহ
সুচৌতে পঞ্চম চীন-ফরাসি সাংস্কৃতিক ফোরাম
পঞ্চম চীন-ফরাসি সাংস্কৃতিক ফোরাম ১৩ ও ১৪ নভেম্বর পূর্ব চীনের চিয়াংসু প্রদেশের সুচৌতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং পারস্পরিক শিক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম এ ফোরাম।
চীন ও ফ্রান্স আগামী বছর তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। এ উপলক্ষ্যে দু’দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব জোরদার করার জন্য এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়।
চীনের জাতীয় গণ-কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, ইউরোপ ও আমেরিকান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তিং চোং লি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং ভাষণ দেন।
‘চীন-ফ্রান্স বন্ধুত্বের নতুন যুগ, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের নতুন সূচনা’- থিমে এ বছরের ফোরামটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আলোচনা ও সংলাপের জন্য সুচৌতে চীন এবং ফ্রান্সের রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আহ্বান করে। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, পর্যটন, জাদুঘর, এবং সমসাময়িক শিল্প বিষয়ে তারা মতবিনিময় করেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে, ফোরামটি ২০১৬ এবং ২০১৯ এর মধ্যে চীন এবং ফ্রান্স উভয় দেশেই বেইজিং, লিয়ন, সি’আন এবং নিসে সফলভাবে চারটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এটি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেক্টরে ব্যবহারিক সহযোগিতা সহজতর করার জন্য, মানুষে মানুষে সংযোগ বৃদ্ধিতে এবং পূর্ব ও পশ্চিমা সভ্যতার মধ্যে বিনিময় ও পারস্পরিক শিক্ষার প্রচারে একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেছে।
২. চিয়াংসির ঐতিহ্য: মাটির পাত্রে স্যুপ
চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ চিয়াংসির নানছংয়ের মাটির পাত্রের স্যুপ একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। স্থানীয় ও দর্শনার্থীদের হৃদয়ে একটি বড় জায়গা দখল করে রেখেছে এই ব্র্যান্ড খাবার।
ক্লাসিক ক্লে-পট স্যুপ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ডিম, প্যাটি স্যুপ, পদ্ম মূল এবং পুরানো হাঁসের স্যুপ ছাড়াও বিভিন্নভাবে এটি তৈরি করা হয়।
মুরগি, হাঁস, মাছ এবং শুকরের মাংসসহ আরও বিভিন্ন উপাদান দিয়ে নানছং ক্লে-পট স্যুপ তৈরি করা হয়,
প্রিমিয়াম উপাদান এবং জলের মিশ্রণ স্যুপের একটি অসাধারণ স্বাদ তৈরি করে, যা সব বয়সের মানুষ খেতে খুব পছন্দ করে।
ছাং ওয়েইতং ৪০ বছর ধরে এই স্যুপ রান্না করছেন। নানছংয়ের বর্তমান উন্নয়ন অবস্থানের পেছনে এই স্যুপের জনপ্রিয়তা একটি বড় কারণ বলে জানান এই রন্ধনশিল্পী।
নানছং দশটি নদী এবং অগণিত হ্রদের মিলনস্থল। জলের এই প্রাচুর্য, বিস্তৃত পাহাড় এবং সতেজ বাতাসের সঙ্গে মিলিত হয়ে নানছংকে একটি আনন্দদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী সৌন্দর্যের একটি বিশেষ শহরে পরিণত করেছে।
মাটির পাত্রের স্যুপের জন্য একটি বিশেষ বাটি তৈরি করা হয়। আর একটি নিখুঁত বাটিতে স্যুপ তৈরির করার পূর্বশর্ত হলো বাটিটাকে সেদ্ধ করা। সাধারণত স্যুপের বাটিগুলো একটি বিশাল মাটির পাত্রে কাঠকয়লার আগুনে আট ঘন্টা সিদ্ধ করা হয়।
স্যুপ রান্নার জন্য ব্যবহৃত মাটির পাত্রগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেগুলো জল এবং তেল শোষণ করতে পারে। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো স্যুপের উপাদানগুলোর প্রাণবন্ত স্বাদকে ক্ষুদ্র ৩ শ’ মিলিলিটার মাটির পাত্রে মিশে যেতে সক্ষম করে।
প্রোটিন এবং উপাদানগুলোকে সম্পূর্ণরূপে দ্রবীভূত করার জন্য এটি সিদ্ধ করার আগে স্যুপটি দুই ঘন্টা উচ্চ তাপ এবং ছয় ঘন্টা কম তাপে রান্না করা হয়।
মাটির পাত্রের স্যুপ সুস্বাদু, মশলাদার এবং মৃদু স্বাদের হয়ে থাকে। এটি চিয়াংসির ভৌগলিক স্বাতন্ত্র্যকেই শুধু প্রকাশ করে তা নয় উত্তর-পশ্চিমের হুনান, হুবেই এবং আনহুই, সেইসাথে দক্ষিণ-পূর্বের চেচিয়াং, ফুচিয়ান এবং কুয়াংতোংয়ের বৈশিষ্ট্যকেও তুলে ধরে।
সতেজতা, মশলাদার এবং স্নিগ্ধতা মিশ্রিত করে, চিয়াংসির রন্ধনপ্রণালী একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা দিতে তাজা উপাদান, দক্ষতা এবং রঙ ব্যবহার করার উপর জোর দেয়।
জন স্থানান্তর, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সংমিশ্রণ এবং সাংস্কৃতিক উন্মুক্ততার মাধ্যমে প্রভাবিত চিয়াংসির রন্ধনপ্রণালী ক্রমাগত নানা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের সারাৎসারকে গ্রহণ করেও এটি একটি স্বতন্ত্র রন্ধনশৈলী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী।
৩. ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রার সুবর্ণজয়ন্তী সফর
যুক্তরাষ্ট্রের সুবিখ্যাত ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০০ সালে। আর প্রথম মার্কিন সংগীত-দল হিসেবে এটি ঐতিহাসিক চীন সফরে আসে ১৯৭৩ সালে।
তারপর গত ৫০ বছরে ১২ বার চীন সফরে আসে দলটি। চীনের বিভিন্ন শহরে অসংখ্য স্মরণীয় পরিবেশনার মধ্য দিয়ে স্থানীয় শ্রোতা, সংগীতজ্ঞশিল্পী ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন তারা। হয়ে ওঠেন দু’দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দূত।
প্রথম ঐতিহাসিক সফরের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে ৯ থেকে ১৮ নভেম্বর চীন সফরে রয়েছে ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রা।
সফরের শুরুতে বেইজিংয়ে তিয়াওইথাই রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় দলটিকে জানানো হয় উষ্ণ অভ্যর্ত্থনা।
উৎসবমুখর সংবর্ধনার মধ্যে ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রা এবং চীনের শিশুশিল্পীরা সমবেতভাবে পরিবেশন করে সুবিখ্যাত চীনা লোকসংগীত মো লি হুয়া বা জেসমিন ফ্লাওয়ার লোক গানটি।
৫০ বছর আগের প্রথম দলটির তরুণ সদস্য বেহালাবাদক ডেভিড বুথও রয়েছেন ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রার সুবর্ণজয়ন্তী দলে। আবেগতাড়িত বুথ তুলে ধরেন চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে গুরুত্বের কথা।
‘এটি একটি দুর্দান্ত অনুভূতি, বিশেষ করে এতগুলো বছর পর, এবং আরও বিশেষ করে এখন ৫০ বছর পেছনে ফিরে তাকালে, আমি এই সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করি। আমরা সারা বিশ্বে অনেক দেশে পরিবেশনা করেছি, কিন্তু বিশেষ করে এই সময়ে, আমাকে বলতেই হবে যে, এখন পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চীনের সঙ্গে, এবং এটি বিভিন্ন স্তরে ক্রমাগত বাড়ছে’।
সুবর্ণ জয়ন্তী সফরটি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক বিনিময়কে আগামী দিনগুলোতে আরও গভীর করবে বলে মনে করেন ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রার সহকারি নির্দেশক ট্রিস্টান রেইস-শারমেন।
‘এটি চলতি বছর আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ সফর এটি। ঐতিহাসিক এ ক্ষণটি উদযাপনে শামিল হতে পেরে আমরা খুবই উচ্ছ্বসিত! আমাদের দলে প্রথম দলটির দুজন সদস্য এখনো আছেন। আজ এখানে একজন বাজিয়েছেন, যিনি ১৯৭৩ সালে প্রথম সফরেও বাজিয়েছিলেন। কত দীর্ঘ একটা ঐতিহ্যকে আমরা ধারন করেছি। এ উদযাপনের অংশ হতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি’।
এ সফরটি কোভিড মহামারি উত্তর চীন-যুক্তরাষ্ট্র সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নতুন সূচনা বলে মনে করেন তরুণ এই নির্দেশক।
আমার আশা নিশ্চিতভাবে ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রা ও চীনের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা আগের মতোই শক্তপোক্ত থাকবে। আমি আরও আশা করি যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অর্কেস্ট্রগুলোও দ্রুত চীন সফরে আসবে। কাজেই আমাদের সফরটি অন্য সফরের একটা ভালো সূচনা বিন্দু।
১০ দিনের সফরে রাজধানী বেইজিং ছাড়াও থিয়ানচিন, সুচৌ ও সাংহাইতে থাং রাজবংশের সময়কার কবিতাসহ নানা মনোমুগ্ধকর পরিবশেনায় চীনা দর্শক-শ্রোতার হৃদয় জয় করে ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রা।
প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম।
---------------------------------------------------------------------------
সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ।