বাংলা

চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-২৫

CMGPublished: 2023-07-15 15:21:38
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

চীনের সংস্কৃতি-সপ্তাহ

আরানইয়া থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল

সমুদ্রতীরে বিশাল মঞ্চ। অভিনয় করছেন দেশি-বিদেশি অভিনেতারা। চলছে আরানইয়া থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল।

উত্তর চীনের হ্যপেই প্রদেশে ছিনহুয়াংতাও সিটিতে সদ্য সমাপ্ত এই ফেস্টিভ্যালে ১২টি দেশের প্রায় ৪০টি পরিবেশনা দর্শককে মাতায়। সমুদ্রতীরে খোলা আকাশের নিচে চলে ব্যতিক্রমী পরিবেশনা।

মঞ্চে অভিনয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের নামিদামি শিল্পীরা। সেইসঙ্গে খ্যতিমান চীনা শিল্পীরাও তাদের নাচে-গানে-অভিনয়ে মুগ্ধ করেন দর্শকদের। উদীয়মান তরুণ শিল্পীরাও অংশ নেন এতে। চীন ও চীনের বাইরে থেকেও আসেন দর্শকরা।

আরানইয়া হলো বেইজিং থেকে পূর্ব দিকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের উপকূলে গড়ে ওঠা একটি শিল্প সম্প্রদায়। উত্তর চীনের হ্যপেই প্রদেশের ছিনহুয়াংতাও-এর দীর্ঘ উপকূলে ২০১৩ সালে এই শিল্প সম্প্রদায় গড়ে ওঠে।

সদ্যসমাপ্ত থিয়েটার উৎসবে মঞ্চে ও উন্মুক্ত স্থানে নাট্য প্রদর্শনী হয়েছে। অনেক রকম পরীক্ষামূলক ও নতুন শিল্পধারার প্রদর্শনী দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।

হোহটে ২০তম গ্রাসল্যান্ড সাংস্কৃতিক উৎসব

উত্তর চীন শহরের হোহট সিটিতে ২০ তম গ্রাসল্যান্ড সাংস্কৃতিক উৎসব শুরু হয়েছে। আর এই উৎসবে গেল সপ্তাহে উত্তর চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী গান ও অন্যান্য গানের একটি জমকালো কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে।

কনসার্টে ইনার মঙ্গোলিয়া ছাড়াও বাইরের ২০ জনেরও বেশি শিল্পী ক্ল্যাসিক গান পরিবেশন করেন।

গানের তাল আর ছন্দে মেতে উঠেন দর্শক শ্রোতারা। ৮ জুলাই শুরু হওয়া ৩০ দিনব্যাপী এই উৎসবে মোট ২৮টি উপস্থাপনা মঞ্চস্থ হওয়ার কথা রয়েছে।

শৈল্পিক পরিবেশনার মাধ্যমে চীনা সংস্কৃতির প্রচারের জন্য ২০০৪ সাল থেকে এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

হ্যনানে ফটোগ্রাফি উৎসব

মধ্য চীনের হ্যনান প্রদেশের সানমেনসিয়া শহরে আয়োজিত ১৪তম চীন ফটোগ্রাফি উত্সবে দেশটির সাম্প্রতিক কয়েক বছরের ফটোগ্রাফিক সৃষ্টির অর্জনগুলো প্রদর্শন করা হয়েছে।

র ফটোগ্রাফার অ্যাসোসিয়েশন জানায়, এ বছরের ফটোগ্রাফি উৎসবে পরিবেশ, বায়ুমণ্ডল এবং সংবেদনশীলতা তৈরি করতে ভিন্নরকম আয়োজন করা হয়। প্রজেকশন, স্ক্রিন, লাইট বক্স, হলোগ্রাফিক ডিভাইসের ব্যবহারকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এর মাধ্যমে জীবন এবং শিল্পকে যারা ভালোবাসে তাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সুযোগ হয়।

উৎসবের আয়োজকদের মতে এই প্রদর্শনী আলোকচিত্রের সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। পাশাপাশি সৃজনশীল কাজেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

চিরায়ত চীনা সাহিত্য

বিষন্নতার কবি লি ছিংচাও

চিরায়ত চীনা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি লি ছিংচাও। সং রাজবংশের সময়কার এই কবিকে মনে করা হয় সমগ্র চীনা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি।

লি ছিংচাওয়ের জন্ম ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দে শানতং প্রদেশের চিনান শহরে। তিনি একটি সম্ভ্রান্ত পন্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা লি ক্যফেই ছিলেন অধ্যাপক, নামকরা লেখক এবং বিখ্যাত কবি সুশির নেতৃত্বে পরিচালিত একটি কবিতাদলের সদস্য। লিয়ের মা ছিলেন সে সময়কার নামকরা কবি। তাদের বাড়িতে বিভিন্ন বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল। তাই ছোটবেলা থেকেই বই পড়ায় মনোযোগী হন লি। শৈশব থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন লি। সুন্দরীও ছিলেন তিনি। অভিজাত মহলে সুন্দরী কবি হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

১১০১ সালে আঠারো বছর বয়সে লি’র সঙ্গে বিয়ে হয় চাও মিংছাং নামের এক অভিজাত তরুণের। চাও ছিলেন সুদর্শন, বীর এবং কবি। ফলে দু’জনের দাম্পত্য প্রেম সুমধুর হয়ে ওঠে। দু’জনেই সাহিত্য ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ক্যালিগ্রাফি ভালোবাসতেন। পরষ্পরের প্রতি তারা কবিতা লিখতেন। এই সুখী দাম্পত্য জীবন লি এর কবিতায় প্রভাব ফেলে। তার কবিতা আরও পরিপক্কতা অর্জন করে এবং সেটি শান্ত ও স্নিগ্ধ ভালোবাসার প্রকাশে অনবদ্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু তার এই সুখী জীবনে অচিরেই ঘনিয়ে আসে দুভার্গ্যের ছায়া।

সং রাজবংশ ও জুরচেনদের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর সংরাজধানী খাইফাংয়ের পতন ঘটে ১১২৭ সালে। যুদ্ধ শানতোং প্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং লির বসতবাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। লি এবং চাও প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান ইয়াংজি নদী ধরে আরও দক্ষিণে নানচিং শহরে। ১১২৯ সালে টাইফয়েড জ্বরে মৃত্যু হয় চাও এর।স্বামীর মৃত্যুতে দুঃখে ভেঙে পড়েন লি। প্রাণের ভয়ে তাকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়। এরপর হাংচৌ শহরে সং সরকারের নতুন রাজধানী গড়ে উঠলে তিনি সেখানে যান। হাংচৌ শহরে কিছুটা স্থিতু হলে তিনি কবিতা লিখতে থাকেন। ওইসব কবিতায় তার হারানো জীবন, নিজের জন্মভূমি, প্রয়াত স্বামীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশিত হয়।

পাশাপাশি তিনি তাদের সংগ্রহ করা ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যগুলোও প্রাণপনে সংরক্ষণ করেন। তিনি এ বিষয়ে লেখেন। চাও এর কবিতা এবং নিজের কবিতাও সংকলিত করেন। একাকী ও দুখী লি, চাং রুচোও নামের একজনকে বিয়ে করেন। কিন্তু এই লোক তার সঙ্গে এত দুর্ব্যবহার করে যে কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের ডিভোর্স হয়। এরপর থেকে লি একাই বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। ১১৫৫ সালে ৭০ বা ৭১ বছর বয়সে লি এর মৃত্যু হয়। লি এর অনেক কবিতা যুদ্ধের ডামাডোলে হারিয়ে গেছে যা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি বলে বিবেচিত।

লি ছিংচাও বিশেষ ধরনের সি কবিতা লেখার জন্য বিখ্যাত। লি এর কবিতায় যে গীতিময়তা, অন্তঃমিল ও ছন্দের ব্যবহার রয়েছে তা অনবদ্য। ভালোবাসা, বিরহ, শোক তার কবিতায় করুণ রস সৃষ্টি করেছে। লি এর একটি কবিতা শোনাচ্ছি।

মৃদু মৃদু সুর

যা হারিয়েছি তাকে খুঁজি

যদিও জানিনা সেটি কি

আমি এত বিষন্ন, এত দুঃখী

এত একা, কোনো সুখ নেই মনে

এই কঠোর শীতে

নিজেকে সুস্থ রাখা এত কঠিন।

পাত্রের পর পাত্র পানীয় পানে কোনোমতে উষ্ণ রাখি নিজেকে

কিভাবে আমি সহ্য করবো সন্ধ্যায় তুহিন হাওয়ার তীব্র প্রবাহ?

যখন দেখি বুনো হাঁসেরা উড়ে যায়, আমার হৃদয় দুঃখে ভেঙে যায়

তারা যেন আমার হারানো অতীতের সঙ্গী

হলুদ ফুলে ঢেকে গেছে জমি

বৃষ্টির মতো ঝরেছে ফুল

কে তাদের কুড়োবে এখন?

জানালার পাশে বসে থাকি একা

যে গভীর অন্ধকারে চারিদিক ঢাকা

কিভাবে পার হবো তা?

প্যারাসল গাছে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে

ধূসর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

লি ছিংচাও তার কবিতায় বিষন্নতা, প্রেম, ও নস্টালজিয়া প্রকাশের জন্য চিরায়ত চীনা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন।

---------------------------------------------------------------------------

প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: রওজায়ে জাবিদা ঐশী, শান্তা মারিয়া

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn