চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-২৩
এক নজরে চীনের সংস্কৃতি-সপ্তাহ:
হংকংয়ে চলচ্চিত্র সংগীতবিষয়ক অনুষ্ঠান
‘উপসাগর এলাকার চলচ্চিত্রের সংগীতানুষ্ঠান-২০২৩’ বৃহস্পতিবার হংকংয়ে আয়োজিত হয়।
খ্যাতিমান চলচ্চিত্রাভিনেতা জ্যাকি চান ও চাং চি ই-সহ তাইওয়ান প্রণালীর দু’পারের এবং হংকং ও ম্যাকাওয়ের চলচ্চিত্রাঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ, সংগীতজ্ঞ এবং সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিজ্ঞান মহলের শতাধিক প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেন।
কুয়াংতং-হংকং-ম্যাকাও বৃহত্তর উপসাগরীয় এলাকার এ অনুষ্ঠানটি ২০২১ সালে শেনচেন শহরে প্রথম আয়োজন করা হয়। দু’বছর পর এবার আয়োজন করা হলো হংকংয়ে।
এ অঞ্চলের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের গানকে তুলে ধরার পাশাপাশি, ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’র সাফল্য তুলে ধরা এবং কুয়াংতং-হংকং-ম্যাকাও উপসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত উন্নয়নের চীনা গল্প বলাও ছিল অনুষ্ঠানের লক্ষ্য।
তৃতীয় চায়না মিডিয়া কনভারজেন্স সম্মেলন
ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন নিউ মিডিয়া অ্যালায়েন্সের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় চায়না মিডিয়া কনভারজেন্স সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
‘রেডিও এবং টিভি মিডিয়ার সমন্বিত উন্নয়নকে গভীর করা এবং চীনকে সংস্কৃতিতে শক্তিশালী একটি দেশে গড়ে তোলার প্রচার’ এই থিম নিয়ে গেল বুধবার বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন।
মূল ফোরামের পাশাপাশি, তৃতীয় চায়না মিডিয়া কনভারজেন্স কনফারেন্সে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং মিডিয়া উদ্ভাবন বিষয়ক সিম্পোজিয়ামসহ একটি বিশেষ কার্যক্রম এতে অনুষ্ঠিত হয়।
ন্যাশনাল রেডিও এবং টিভি নিউ মিডিয়া অ্যালায়েন্স হলো ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোতে মূলধারার রেডিও এবং টিভি আউটলেটগুলোর উপস্থিতি বাড়ানো। পাশাপাশি সব ধরণের মিডিয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য একটি উদ্ভাবনী অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে জাতীয় রেডিও এবং টেলিভিশন প্রশাসনের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ এটি।
দুই.
সাংহাই টিভি ফেস্টিভ্যালে ম্যাগনোলিয়া পুরস্কারসহ সেরা টিভি শোগুলো পুরস্কৃত
মর্যাদাপূর্ণ ম্যাগনোলিয়া পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ২৮তম সাংহাই টেলিভিশন উৎসব। সম্প্রতি সারা বিশ্বের সেরা টেলিভিশন প্রযোজনাকে সম্মাননা দেয়ার মধ্য দিয়ে জমকালো এ ইভেন্টের সমাপ্তি হয়।
এবারে সাংহাই টিভি ফেস্টিভ্যালে বিশেষ পুরস্কার জিতে নিয়েছে চায়না মিডিয়া গ্রুপ সিএমজির নির্মিত একটি বড় আকারের গ্র্যান্ড প্রোডাকশন টিভি তথ্যচিত্র ‘চার্টিং দ্য ডিকেড’। সিরিজটি চীনের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর একটি গভীর অনুসন্ধান।
আকর্ষণীয় নাটক ‘এ লাইফলং জার্নি’ একাধিক বিভাগে বিজয়ী হয়েছে। সেরা চীনা টিভি নাটক, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রনাট্য, প্রধান চরিত্রে সেরা অভিনেতা, এবং পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেতাসহ পাঁচটি সম্মানজনক প্রশংসা অর্জন করে ‘এ লাইফলং জার্নি’। সিরিজটি একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের উন্নত জীবন গঠনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়ে দর্শকদের বিমোহিত করেছে।
২৮তম সাংহাই টিভি ফেস্টিভ্যাল ম্যাগনোলিয়া অ্যাওয়ার্ড গ্র্যান্ড প্রিক্স জিতেছে ‘মেডেল অফ দ্য রিপাবলিক’, ‘ডিসাইসিভ ভিক্টরি’ এবং ‘আওয়ার টাইমস’। আর বেস্ট ভ্যারাইটি প্রোগ্রাম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ‘হোমস ইন বিউটিফুল চায়না’ এবং ‘চাইনিজ ফেস্টিভ্যাল’ সিরিজকে।
সাংহাই টেলিভিশন ফেস্টিভ্যাল গত বছর কোভিডের কারণে স্থগিত হওয়ার পর গেল ১৯ জুন শুরু হয়ে চলে চারদিনব্যাপী। এ বছর, পাঁচটি মহাদেশের ৪৯টি দেশ এবং অঞ্চল থেকে প্রায় দু’হাজার টিভি শো পুরস্কারের জন্য নিবন্ধন করে।
চার. চীনের খ্যাতিমান ‘বাঘচিত্রি’ ফেং তাচোং
উত্তরপূর্ব চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের এ চিত্রশিল্পী ফেং তাচোং বাঘের ছবি এঁকে খ্যাতি পেয়েছেন। তাঁর আঁকা বাঘকে বলা হয় পৃথিবীর সুন্দরতম বাঘ। চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক-সিজিটিএনের ছয় পর্বের তথ্যচিত্র আর্ট-বিটের একটিতে উঠে এসেছে বরেণ্য এ শিল্পীর জীবন ও শিল্পচর্চার পূর্বাপর।
হেইলুংচিয়াং প্রদেশের বেনসি সিটি বাঘের জন্য বিখ্যাত। এটি চীনের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ফেং তাচোংয়ের হোমটাউন। নিজের শহরের প্রতি ভালোবাসা, এর পাহাড়-নদী, রাজসিক বাঘ- সঙ্গত কারণেই প্রভাব ফেলেছে তাঁর চিত্রকর্মে। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বাঘের ছবি এঁকে তিনি পেয়েছেন চীন-জোড়া খ্যাতি।
একেবারে ছোটবেলা থেকেই চিত্রশিল্পী হবার স্বপ্ন দেখেন ফেং তাচোং। স্কুলে চিত্রকলার ক্লাসে শিক্ষদের আঁকা ছবি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতেন তিনি। সেই বিস্ময়ই তাঁকে শিল্পী-জীবনের দিকে চালিত করে।
অংকন দক্ষতা অর্জন করতে ফেং সারাদেশ ভ্রমণ করেন। এখনো সময়কার হলুদ স্কেচবুক এখনো তিনি সযতনে আগলে রেখেছেন।
তবে, সারাদেশে বিখ্যাত সব পাহাড়-নদী, প্রকৃতি অবলোকন করলেও শেষ পর্যন্ত নিজের হোমটাউন বেনসির অখ্যাত পর্বত-নদী-প্রকৃতির ছবি আঁকতেই স্বচ্ছন্দ ফেং তাচোং।
‘আমি চীনের প্রায় সব মহিমামণ্ডিত পাহাড় আর নদী দেখেছি। কিন্তু ও থেকে আমি শুধু এ অনুভূতিটা পেয়েছি যে পৃথিবীটা কত বড়! ওই নদী আর পাহাড়গুলোর কী অপূর্ব শোভা। কিন্তু যখন আঁকার কথা ভেবেছি, আমার নিজের শহরের পাহাড়-নদী আঁকতেই আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছি। ওই অখ্যাত পাহাড়-নদীগুলোই আমার শিল্পীসত্তার ভালোবাসা পেয়েছে’।
পাহাড়-নদী, প্রকৃতির ছবি আঁকায় স্বীকৃতিও মেলে ফেং তাচোংয়ের। ১৯৮৪ সালে জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে সর্বোচ্চ পুরস্কার সিলভার মেডেল লাভ করেন তিনি। ‘জাগরণ’ শিরোনামে তার যৌথ সেই চিত্রকলাটি চীনের জাতীয় শিল্প যাদুঘরে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।
১৯৮০’র দশক থেকে ফেং তাচোং তাঁর প্রথম ভালোবাসা- বাঘের ছবি আঁকায় মনোযোগী হন ফের। চাংপাই পাহাড়ের সাইবেরিয়ান বাঘের ছবি আঁকতে থাকেন তিনি। স্থানীয় চিড়িয়াখানায় বহুবছর ধরে বিরতীহীনভাবে প্রায় প্রতিদিন বাঘের ছবি এঁকেছেন তিনি।
‘প্রাচীন কাল থেকেই চীনের মানুষ বাঘ-অনুরাগী। বাঘ শক্তি ও সাহসের প্রতীক। চীনা প্রবাদেও বাঘের বলিষ্ঠতা ও প্রাণপ্রাচুর্যের কথা বলা হয়েছে। আমিও আমার ছবিতে বাঘের বলিষ্ঠতা এবং শক্তির প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছি’।
৪০ বছর বয়সের পর ফেং তাচোং শক্তি ও হিংস্রতার দিকটি ছাড়িয়ে বাঘের স্বভাবের বিচিত্রমুখি প্রবণতা অনুসন্ধান করেন। বাঘের প্রাচীন চিত্রকর্ম অনুধাবন আর নিজের স্কেচ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি অনন্য সাধারণ শিল্পরীতি গড়ে তোলে খ্যাতিমান এ বাঘচিত্রি।
‘আমি দেখলাম সঙ্গী এবং শাবকের প্রতি বাঘের ভালোবাসার অনুভূতি রয়েছে, তার প্রকাশ রয়েছে। বাঘের মধ্যে আমি মানবসদৃশ্য স্বভাব আবিষ্কার করলাম। ছবি আঁকতে আঁকতে আমি নতুন অন্তর্দৃষ্টি লাভ করলাম এবং ছবিগুলো স্থায়ীত্ব অর্জন করলো’।
শুধু বড়শিল্পী হিসেবে নয়, শান্তিপ্রিয় ও বিনম্র স্বভাবে সবাইকে মোহিত করেন ফেং তাচোং। প্রথম জীবনে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেলেও তাঁর চিত্রকলায় সবসময় তাঁর ভালোবাসাপূর্ণ মন আর গভীর অনুভূতিই চিত্রিত হয়েছে।
---------------------------------------------------------------------------
প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: আবদুল্লাহ আল মামুন, শান্তা মারিয়া, মাহমুদ হাশিম
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ, নাজমুল হক রাইয়ান
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম
সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।