চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-১৫: মে দিবসের অবকাশে চীনজুড়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন
আয়োজনে, উৎসব-মুখরতায় মে দিবসের ছুটি কাটিয়েছেন চীনের মানুষ। ২৯ এপ্রিল শুরু হওয়া ৫ দিনের ছুটি শেষ হয়েছে বুধবার।
মে দিবস উদযাপনে রাজধানী বেইজিংসহ শহরগুলো সাজে উৎসবের সাজে। আলোকসজ্জা, আতশবাজি, আর বর্ণাঢ্য লাইট শো বর্ণবিভা ছড়ায় শহরগুলোর রাতের আকাশে।
ছুটি কাটাতে শহর ছেড়ে অনেকে চলে যান পল্লী-প্রকৃতির কাছাকাছি। সর্বত্রই ছিল ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির পরিবেশনাসহ নানান সাংস্কৃতিক আয়োজন। আর এত সব আয়োজনে চাঙ্গা হয়ে ওঠে চীনের পর্যটন শিল্প।
মে দিবসের ৫ দিনের ছুটিতে পূর্ব চীনের চিয়াংসু প্রদেশের হুয়াইয়ান সিটির রাতের আকাশ ঝলমল করে বর্ণাঢ্য আতশবাজির ঝলকানিতে।
ড্রোনের মাধ্যমে মে দিবসের নানা শুভেচ্ছা-জ্ঞাপক ফর্ম- হ্যাপি লেবার ডে হলিডে, স্যালুট টু ওয়ার্কাস- প্রভৃতি চমকিত করে এখানকার বাসিন্দা ও পর্যটকদের।
একজন পর্যটক জানালেন তার উচ্ছ্বাসের কথা:
‘আকাশের বুকে ড্রোন শোটা সত্যি দেখবার মতো ছিল। প্রতিটি আয়োজন দুর্দান্ত। আতশবাজির অগণন বিচ্ছুরণ সত্যিই উপভোগ্য ছিল’।
উৎসব-আয়োজনে স্থানীয় খাবারের দোকানগুলো খদ্দের সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খায়।
একজন বিক্রেতা বলছিলেন খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার কথা:
‘মরা আড়াই শ কিলোগ্রাম চিংড়ি রেখেছিলাম। ঘন্টা পেরুবার আগেই সব বিক্রি হয়ে গেছে’।
উত্তর পশ্চিম চীনের শাআনসি প্রদেশের রাজধানী সিয়ানে সাধারণ শ্রমিকদের সম্মান জানাতে শহরের প্রধান প্রধান ভবনগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়।
শহরের অলিম্পিক স্পোর্টস সেন্টারটি লাল-হলুদ আলোয় ‘সেলিব্রেট লেবার ডে’, ‘গ্লোরি বিলংস টু ওয়ার্কার্স’ প্রভৃতি শুভেচ্ছাজ্ঞাপক বাণী উৎকীর্ণ করা হয়।
এখানে দর্শণার্থীদের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলা, খাবার উপভোগ ও নাচ গানসহ ঐতিহ্যগত পোশাক পরিধানের ব্যবস্থা ছিলো। আয়োজকরা চীনের জাতীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে তালিকাভুক্ত "থাং রাজবংশের ইয়ান মিউজিক" এর মতো পারফরম্যান্সও এতে যুক্ত করেন।
শানসি সংস্কৃতি ও পর্যটন কোম্পানি বোর্ডের চেয়ারম্যান চৌ লিনফেং তুলে ধরেন এর গুরুত্বের কথা:
‘যখন পর্যটকরা ছাংআন এলাকায় পা রাখেন, তখন তারা ব্যক্তিগতভাবে থাং রাজবংশের লোকদের দৈনন্দিন জীবন অনুভব করতে পারে। আমরা চেষ্টা করেছি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করতে এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতির অনন্য আকর্ষণ তুলে ধরতে’।
শহুরে পরিবেশে মে দিবস উদযাপনের পাশাপাশি অনেকে অবকাশ যাপনে ছুটে গেছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত গ্রাম এলাকায়।
সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নানা লোকসংস্কৃতির পরেবেশনা রাঙিয়ে তোলে তাদের ছুটির অবকাশকে।
মধ্যচীনের হ্যনান প্রদেশের তংপাই কাউন্টিতে রঙিন আজালিয়া ফুলের সমুদ্রে যেন ডুবে রয়েছে তংপাই পাহাড়।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, মে দিবসের ছুটির দিনগুলোতে এখানে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজারের বেশি দর্শনার্থী ভ্রমন করেন।
রাজধানী বেইজিংয়ের অনেকে শিশুসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরতলীর বিভিন্ন ফার্ম হাউসে অবকাশ কাটান।
উন্মুক্ত পরিবেশ বিনকার্ড তৈরি, ক্যাম্পিং ও শাকসবজি আর ফলমুল সংগ্রহ তাদের তরতাজা হয়ে ওঠান অনুভূতি দেয়।
দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ছোংছিং মিউনিসিপ্যালিটিতে স্থানীয় মিয়াও জাতির মানুষজন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নেচে-গেয়ে পর্যটকদের স্বাগত জানান।
২. চীনের চিত্রকলা:
ফান ইয়াং: চীনের খ্যাতিমান ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্পী
চীনের খ্যাতিমান ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্পী ফান ইয়াংয়ের জন্ম ১৯৫৫ সালে হংকংয়ে। বেড়ে ওঠেন পূর্বচীনের চিয়াংসু প্রদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নানতং শহরে। তাদের পরিবারে জন্মেছিলেন অনেক খ্যাতিমান কবি, ক্যালিগ্রাফার এবং চিত্রশিল্পী। কাজেই চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি ও চিত্রকলার প্রতি ভালোবাসাটা ফান ইয়াং পেয়েছিলেন জন্মগতভাবে পরিবার থেকে।
‘কবি এবং শিল্পী পরিবারে আমার জন্ম। আমাদের পরিবার অনেক কবি, লেখক ও শিল্পীর জন্ম দিয়েছে। কাজেই একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আমি বড় হয়েছি। নানতংয়ে আপনারা আমাদের পুরনো বাড়ি বেড়াতে যেতে পারেন। মিং ডাইনেস্টির সময়কালে তৈরি ওটা। দেখবেন বাড়ি বিশাল গেটে লেখা রয়েছে ‘চিনসিদি’ বা স্কলারস রেসিডেন্ট। আমার পূর্বপুরুষদের একজন চিনসি ছিলেন- অর্থাৎ রাজদরবারে নিয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন’।
একেবারে ছোটবেলা থেকেই চাচা খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ফান চেংয়ের উৎসাহে চিত্রকলার প্রতি আগ্রহী হন ফান ইয়াং।
১৯৭৭ সালে ফান ইয়াং নানচিং নর্মাল কলেজে ভর্তি হন। বিখ্যাত সেই কলেজটি তার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রকলা শিক্ষা। স্নাতক হবার পর সেখানে ২৩ বছর শিক্ষকতা করেন ফান ইয়াং। ২০০৫ সালে তিনি চীনের জাতীয় চিত্রকলা একাডেমির ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং রিসার্স অফিসে পরিচালক নিযুক্ত হন। ফান ইয়াং মনে করেন, চীনের চিত্রকলা মূলত বিস্তৃত ক্যানভাস নিয়ে কাজ করে। তবে ছোটখাট বিষয়বস্তুতেও তার সমান নজর।
‘চীনের ঐতিহ্যিক চিত্রকলায় একটা দারুণ ব্যাপার আছে! চীনের চিত্রকলার থিম এবং ক্যানভাস খুবই বিস্তৃত। এক টুকরো কাগজে হাজার হাজার মাইলের নদী ও পর্বতমালা আঁকা যায়। আবার গুবরে পোকা, প্রজাপতি কিংবা ঘাসফুল- কিছুই গুরুত্ব হারায় না। প্রকৃতির ছোটখাট বস্তু দিয়েও আমরা নিজেদের প্রকাশে সিদ্ধহস্ত’।
ফানা ইয়াং মনে করেন শিল্পীদের একটু মুক্তমনা হতে হয়। তাদেরকে সামাজিক রীতি-রেওয়াজ ও সময়ের পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। তাহলেই কেবেন একজন শিল্পী তাঁর তুলিতে সময়কে ধরতে পারেন। ৬৭ বছর বয়সী এ চিত্রশিল্পী মনে করেন তার কাজ নতুন যুগে নতুন মানুষের কাছে চীনের মহান আখ্যান তুলে ধরবে। কারণ চীনের অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে কোভিড মহামারি সামাল দিতে ব্যস্ত চিকিৎসাকর্মী- সবকিছুই তার তুলির আঁচড়ে মূর্ত হয়েছে।
এ ছবিটি কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ছবি। আমি এর নাম দিয়েছি রিডিং নোটস। আমি আসলে একটি আলোকচিত্র এঁকেছি। এটা খুবই আবেগতাড়িত করে। কিছু ডাক্তার একটি সিটি স্ক্যান বিশ্লেষণ করছেন, কেউ মাস্ক পরে আছেন, নার্সরা স্যালাইনের বোতল ধরে রয়েছেন। এটি একটি বিশেষ সময়ের অ্যাখ্যান।
ফান ইয়াং মনে করেন যখন একজন শিল্পী সময়ের দাবি আর নিজের হৃদয়ের স্পন্দনকে মেলাতে পারেন তখনই সৃষ্টি হয় শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি। ফান ইয়াং চীনের প্রথম চিত্রশিল্পী সুইজারল্যান্ডের লুসানের অলিম্পিক মিউজিয়ামে যার প্রদর্শনী হয়েছে।
২০২২ সালে বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকসে নিজের তুলির আঁচড়ে টিম চায়নার অর্জনকে মূর্ত করেন ফান। অলিম্পিকসে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে তিনি মর্যাদাপূর্ণ পিয়েরে দ্য কুবার্তিন মেডেলে ভূষিত হন।
চিরতরুণ খ্যাতিমান এ শিল্পী ফান ইয়াং এখন তার অগনন ছাত্রছাত্রীর জন্য অশেষ অনুপ্রেরণা ও পথের দিশারি।
------------------------------------------------------------------------------
প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: রওজায়ে জাবিদা ঐশী, মাহমুদ হাশিম
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ, রফিক বিপুল
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম
সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।