চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-১১: চীন-স্পেন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বর্ষপূর্তিতে যৌথ কনসার্ট
চীন ও স্পেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে চায়না মিডিয়া গ্রুপ সিএমজির আয়োজনে বার্সেলোনা ও বেইজিংয়ে একযোগে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এ ইভেন্টে চীন ও স্পেনের শতাধিক শিল্পী অংশ নিয়ে ‘গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তোলা’ এই গানটি পরিবেশন করেন, যা তৃতীয় চীন-ইউরোপ সঙ্গীত উৎসব এবং কনসার্টেরও অংশ ছিল।
কনসার্টে দুটি দেশের নৃত্য এবং সংগীতের ক্লাসিক অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সবের মধ্যে চীনের 'রেড লিলিস ক্রিমসন অ্যান্ড ব্রাইট' ও 'লিউইয়াং নদী' এবং স্পেনের 'কারমেন ফ্যান্টাসি' ও 'মেমোরিস অফ দ্য আলহাম্ব্রা' স্থান করে নেয়।
এর আগে চীনে নিযুক্ত স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত রাফায়েল ডেজকলার ডি মাজারেডো কনসার্টটি আয়োজন করার জন্য সিএমজির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে উল্লেখ করেন, সংগীত এবং সংস্কৃতি বিভিন্ন দেশের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটাতে পারে, যার ফলে প্রতিটি দেশের মানুষ একে অপরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে।
এদিকে, কনসার্টটি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক বিনিময়কে আরো উন্নীত করবে বলে মন্তব্য করেছেন স্পেনে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত উ হাইথাও। এ সময় তিনি দু'দেশের সম্পর্কের ৫০তম কূটনৈতিক বার্ষিকীর কথা উল্লেখ করে বলেন, চীন স্পেনের সঙ্গে তার ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বকে মূল্য দেয় এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করতে নতুন উচ্চতায় কৌশলগত অংশীদারিত্বকে প্রাধান্য দেয়।
গান ও নাচকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে দুই দেশের শিল্পীদের একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারা এবং একসঙ্গে বেড়ে উঠার আশা প্রকাশ করেন চায়না ওরিয়েন্টাল পারফরমিং আর্টস গ্রুপের চেয়ারম্যান চিং সিয়াওয়ং। এতে দু'দেশের সংগীতপ্রেমীরাও উপস্থিত ছিলেন।
কনসার্টটি চীনের সেন্ট্রাল টেলিভিশনের মিউজিক চ্যানেল এবং স্পেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মূলধারার মিডিয়া প্ল্যাটফর্মসহ একাধিক প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচারিত হয়।
এর আগে উদ্বোধনী কনসার্টের মধ্য দিয়ে চীন-স্পেন সংস্কৃতি ও পর্যটন বর্ষ শুরু হয়। স্পেনের মাদ্রিদের জাতীয় সঙ্গীত অডিটোরিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী হু হ্যপিং, কূটনীতিকসহ অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এ সময় চীনা এবং স্প্যানিশ গানের উপাদানের সমন্বয়ে "দ্য সান অলওয়েজ শাইনস অন আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ" নামে দুই দেশের অর্কেস্ট্রাশিল্পীরা একটি নতুন তৈরি করা কাজের অংশ পরিবেশন করেন।
অনুষ্ঠানের আরেকটি অংশে, "দ্য ড্রাঙ্কেন বিউটি" উপস্থাপন করেন চীনা শিল্পীরা। আর পিকিং অপেরার অনন্য শৈলি স্প্যানিশ দর্শকদের মুগ্ধ করে। অন্যদিকে, স্প্যানিশ সোপ্রানো গায়ক এস্টিবালিজ মার্টিনের কণ্ঠে চীনের অন্যতম জনপ্রিয় গান "আই লাভ ইউ, চায়না" চীনা দর্শকদের মুগ্ধ করে। শিল্পী নিজেও আনন্দিত গানটি গাইতে পেরে।
‘আই লাভ ইউ, চায়না’ গানটি আমি গেয়েছি, যেটি সেখানে খুব জনপ্রিয়। আমি এটি গাইতে পেরে সম্মানিত এবং আনন্দিত বোধ করছি। সত্যি বলতে, একজন সোপ্রানো গায়কের জন্য এটি টেকনিক্যালি খুব কঠিন, কিন্তু আমি এটি করেছি। আমার খুব ভালো লাগছে'।
ইভেন্টে অংশগ্রহণকারী বক্তারা জানান, সংস্কৃতি ও পর্যটনের মাধ্যমে চীন এবং স্পেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে। আর এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং উপলব্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
চিরায়ত চীনা সাহিত্য
ওয়েন থিংইয়ুন: চীনের প্রকৃতি ও প্রেমের গীতিকবি
থাং রাজবংশের শেষদিকের কবি ওয়েন থিংইয়ুন। তিনি গীতিকবিতার জন্য বিখ্যাত। থাং রাজবংশের শেষ দিককার এবং সং রাজবংশের সময়কার গীতিকবিতার ধারার অন্যতম সেরা লেখক ওয়েন। তার অনেক কবিতায় ফুলের বাগান সেখানে নিঃসঙ্গ নারীর মনোবেদনা এবং রোমান্টিক ভালোবাসার আবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ওয়েন থিংইয়ুন হুয়া চিয়ান বা সি ধারার প্রতিষ্ঠাতা কবি। এই ধারার কবিতায় ফুল, উদ্যান ইত্যাদির বর্ণনা প্রাধান্য পায়। তার লেখা ৭০টির মতো সি কবিতা বা ফুলের ধারার কবিতা পরবর্তি প্রজন্মের কাছে পৌঁছায় এবং বেশ প্রভাব বিস্তার করে।
ওয়েন থিংইয়ুন শানসি প্রদেশের ছি শহরের কাছে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মসাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকে বলেন তার জন্ম ৮১২ সালে। আবার অনেক পণ্ডিত মনে করেন তার জন্মসাল ৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ।
ওয়েন থিংয়ুন ছিলেন উচ্চবংশজাত। তার পূর্ব পুরুষ ওয়েন ইয়ানপো থাং রাজবংশের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে ওয়েন থিংয়ুন শৈশবেই তার বাবাকে হারান। এই অকাল মৃত্যুর ফলে কবির শৈশব কাটে দারিদ্র্যের মধ্যে। তার লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার বাবার একজন বন্ধু এ সময় সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং তার লেখাপড়ার খরচ জোগান। নিজের ছেলে তুয়ান ছাংশির সঙ্গে ওয়েনকে প্রতিপালন করেন।
তারুণ্যে ওয়েন উচ্চশ্রেণীর মানুষের বেশ প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী লিংহু থাও তাকে বেশ সুনজরে দেখেন। তখন কবি হিসেবেও ওয়েনের বেশ নাম হয়। ওয়েনের একটি কবিতা ‘পু সা মান’ প্রধানমন্ত্রী বেশ পছন্দ করেন। তিনি কবিতাটি সম্রাটের কাছে নিবেদন করেন এবং বলেন যে নিজেই তিনি এটি লিখেছেন। ওয়েনকে তিনি নিষেধ করেন যেন প্রকৃত লেখকের নাম প্রকাশ না পায়। কিন্তু ওয়েন তার ঘনিষ্ঠদের কাছে প্রকাশ করে ফেলেন যে এটি তার লেখা। কথাটি প্রধানমন্ত্রীর কানে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হন।
সরকারি চাকরির পরীক্ষা চিনশিতে যেন কোনভাবেই ওয়েন পাশ না করতে পারেন সেই ষড়যন্ত্র করেন লিংহু থাও। এই ষড়যন্ত্রের কারণে বারে বারে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ওয়েন পুরো পরীক্ষা ব্যবস্থার উপরেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে যান। তখন তিনি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অন্য চাকরি প্রার্থীদের নকল করায় সাহায্য করতেন।
লি সুই নতুন সম্রাট হয়ে ইয়াং শোও নামে নতুন একজনকে প্রধানমন্ত্রী বানান। নতুন সম্রাটের শাসনে ওয়েনের ভাগ্যের কিছুটা উন্নতি হয়। তিনি বড় চাকরি পান। সেসময় তিনি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় যেসব দুর্নীতি হয় সে বিষয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে জানান। এতে পুরো ব্যবস্থাটি স্বচ্ছ হয়। তবে এর ফলে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাকে অপছন্দ করে এবং তার বিরুদ্ধে আবার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ সময় কবি হিসেবে তার জনপ্রিয়তা ছিল। সাধারণ ও অভিজাত দুই শ্রেণীর মানুষের কাছেই তিনি প্রিয় হয়ে ওঠেন। ৮৬৬ সালে তার মৃত্যু হয়।
ওয়েন ভালো গান জানতেন। তাই কবিতাগুলোতে সুর দিয়ে পরিবেশন করতেন। তার কবিতার শিল্পগুণও ছিল উচ্চমানের। শ্রোতাদের জন্য তার একটি কবিতা শোনাচ্ছি।
ভোরবেলায় চলে যাওয়া
ঊষালগ্নে জেগে উঠি, গাড়ির ঘন্টাধ্বনি বাজে
কিন্তু ফেলে আসা গৃহের চিন্তায় মন উদাস হয়ে যায়
জীর্ণ সরাইখানায়, চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর মোরগ ডাকে
তুষার ঢাকা কাঠের সেতুর উপর পড়ে আছে পদচিহ্ন।
ওক গাছের ঝরা পাতায় ঢাকা পাহাড়ি পথ
প্রস্ফুটিত কমলা গাছে উজ্জ্বল ডাকঘর।
গতরাতে জন্মভূমির স্বপ্নে এখনও বিষণ্ন মন
পুকুরের জলে খেলা করছে বুনোহাঁসের দল।
কবি ওয়েন থিংইয়ুন তার গীতি কবিতার সুললিত ছন্দ আর প্রকৃতির রোমান্টিক বর্ণনায় পরবর্তি যুগের কবিদের উপরও প্রভাব বিস্তার করেছেন। এখনও চীনা প্রকৃতি ও প্রেমের গীতিকবিতার জগতে তার স্থান অনন্য।
----------------------------------------------------------------------
প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: রওজায়ে জাবিদা ঐশী, শান্তা মারিয়া
কবিতা অনুবাদ: শান্তা মারিয়া
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ, রফিক বিপুল।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম।
সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।