বাংলা

দেহঘড়ি পর্ব-০২৭

CMGPublished: 2023-07-16 15:34:39
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

থাইরয়েড রোগের চিকিৎসায় টিসিএম

থাইরয়েড রোগ এমন একটি রোগ যা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। গলার দিকে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থিটি থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে, যা রক্তের মাধ্যমে অন্য অনেক অঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এই হরমোনগুলো সাধারণত শরীরে শক্তির ব্যবহার এবং শিশুর বিকাশ ব্যবস্থাপনায় কাজ করে।

থাইরয়েড রোগের পাঁচটি প্রকার রয়েছে, যার প্রত্যেকটির নিজস্ব উপসর্গ থাকে। একজন ব্যক্তির একই সময়ে এক বা একাধিক প্রকার থাইরয়েড রোগ থাকতে পারে। পাঁচটি ধরন হলো: হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতা, হাইপারথাইরয়েডিজম বা অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ, থাইরয়েড গ্রন্থির গঠনগত অস্বাভাবিকতা, যা সাধারণত গলগন্ড হিসাবে প্রকাশিত হয়, টিউমার, এবং কোনও ক্লিনিকাল লক্ষণ ছাড়া অস্বাভাবিক থাইরয়েড ফাংশন।

হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ওষুধে সাধারণত থাইরয়েড হরমোন প্রতিস্থাপন ওষুধের উপর নির্ভর করা হয়। তবে অন্যান্য অনেক রোগের মতো থাইরয়েড রোগের ক্ষেত্রেও ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে প্রত্যেক রোগীর নির্দিষ্ট লক্ষণগুলোর ভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ কারণে এ চিকিৎসায় অনেকগুলো অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

আপনার যদি থাইরয়েড ব্যাধি থাকে এবং আপনি আপনার সামগ্রিক চিকিৎসা পরিকল্পনায় টিসিএম অন্তর্ভুক্ত করতে চান, তবে নিশ্চিত করুন যে, আপনার টিসিএম চিকিৎসক যেসব বিকল্প ব্যবস্থার সুপারিশ করেছেন আপনার প্রাথমিক চিকিত্সক যেন সে সম্পর্কে অবগত থাকেন। তাহলে তারা সম্ভাব্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারবেন।

ভারসাম্য অর্জন

অন্য যে কোনও ব্যাধির মতোই হাইপারথাইরয়েডিজম ও হাইপোথাইরয়েডিজম উভয় ক্ষেত্রে টিসিএমে মনে করে, এ ব্যাধির কারণ শরীরে মূল শক্তি ‘ছি’র ঠান্ডা শক্তি ‘ইয়িন’ এবং তাপশক্তি ‘ইয়াং’র ভারসাম্যহীনতা। টিসিএম’র লক্ষ্য থাকে এই দুই শক্তির মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। টিসিএম চিকিত্সার ফর্মুলা প্রত্যেক রোগীর উপসর্গ অনুসারে তৈরি করা হয়। যেমন ধরুন, হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তি যদি এ রোগের সাধারণ উপসর্গগুলোর পাশাপাশি মাথা ঘোরা বোধ করেন, তাহলে তার চিকিৎসা হবে অন্য রোগীর থেকে আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কলেজ অব ওরিয়েন্টাল মেডিসিন (পিসিওএম) বলছে, থাইরয়েড ব্যাধির চিকিত্সার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো হলো আকুপাংচার, ভেষজ ওষুধ ও খাদ্য থেরাপি।

আকুপাংচার

আকুপাংচারে শরীরের নির্দিষ্ট বিন্দুতে খুব চিকন সূঁচ ঢোকানো হয়, যা শরীরের মধ্য দিয়ে ‘ছি’র প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তির সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতায় ভূমিকা পালন করে। একজন টিসিএম চিকিৎসকের লক্ষ্য থাকে ‘ছি’ প্রবাহে সেই ভারসাম্যহীনতা দূর করা, যা থাইরয়েড ব্যাধির জন্য দায়ী।

ঔষধি

টিসিএমে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় গাছের পাতা, শিকড়, কাণ্ড, ফুল ও বীজ ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে ক্বাথ, দানা বা পাউডারে রূপান্তরিত করা হয়। ভেষজ এককভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে বা কয়েকটি একসঙ্গে মিলেয়েও ব্যবহার করা যায়, যাকে ফর্মুলা বলা হয়। হাজার হাজার চাইনিজ ভেষজের পাশাপাশি অনেক ভেষজ ফর্মুলা রয়েছে। জানিয়ে দেবো সাধারণ কিছু ভেষজ ও ভেষজ ফর্মুলা সম্পর্কে:

হাইপোথাইরয়েডিজমে সাধারণত যেসব ভেষজ ও ভেষজ ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো হলো রেহমাননিয়া (শু তি হুয়াং) ডায়োস্কোরিয়া (শান ইয়াও), কর্নাস (শান চু ইয়ু), কিডনি ইয়িন টনিক (লিউ ওয়েই তি হুয়াং ওয়ান), লিভার ক্লিনজিং (চি চি ছিং কান থাং) এবং হার্ট ইয়িন টনিক (থিয়ান ওয়াং বু সিন তান)। অন্যদিকে হাইপারথাইরয়েডিজমে ব্যবহৃত ভেষজ ও ভেষজ ফর্মুলাগুলো হলো দারুচিনির ছাল (রৌ কুই), অ্যাকোনাইট (ফু চি) এব কিডনি ইয়াং টনিক (চিন কুই শেন ছি ওয়ান)।

এছাড়াও, থাইরয়েড রোগের চিকিত্সার জন্য বেশ কয়েকটি ভেষজ ও ভেষজ ফর্মুলা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইংলিউ মিক্সচার, হাইচাও উহু ক্বাথ এবং সিং ছি হওয়া ইয়িং থাং। বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রমাণ মিলেছে যে, ইংলিউ মিক্সচার ভেষজ সূত্র মেথিমাজোলের সঙ্গে ব্যবহার করা হলে থাইরয়েডের কার্যকারিতা উন্নত হয়। তাছাড়া অন্তত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যান্য প্রচলিত থেরাপির সঙ্গে হাইচাও উহু ক্বাথ ব্যবহার করলে তা গলগণ্ড চিকিত্সায় বেশ ভালো কার্যকর হয়। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গলগন্ডে আক্রান্ত রোগীদের উপসর্গ কমাতে এবং গলগন্ডের আকার কমাতে এই ভেষজ সূত্রটি বেশ ফলদায়ক।

#চিকিৎসার_খোঁজ

হেপাটাইটিস রোগের সেরা চিকিৎসাকেন্দ্র থিয়ানচিন তৃতীয় কেন্দ্রীয় হাসপাতাল

থিয়ানচিন তৃতীয় কেন্দ্রীয় হাসপাতাল চীনের একটি প্রথম শ্রেণির হাসপাতাল, যেখানে চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাশিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং রোগ প্রতিরোধের সম্মিলন ঘটেছে। একটি জেনারেল হাসপাতাল হিসাবে সব ধরনের রোগের চিকিৎসা এখানে করা হয়, তবে হেপাটাইটিস রোগের চিকিৎসায় এটা গোটা চীনে অন্যতম প্রধান হাসপাতাল।

১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত থিয়ানচিন তৃতীয় কেন্দ্রীয় হাসপাতাল থিয়ানচিন অঞ্চলের জন্য কেবল একটি চিকিৎসাকেন্দ্র নয়; এটি থিয়ানচিন চিকিৎসা বিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কলেজ এবং নানকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতালও।

তৃতীয় কেন্দ্রীয় হাসপাতাল কৃত্রিম কোষ প্রকৌশল প্রযুক্তির একটি গবেষণা কেন্দ্র। এছাড়া থিয়ানচিন পৌরসভার জন্য এটি একটি ভেন্টিলেটর থেরাপির গবেষণা কেন্দ্র, ক্লিনিকাল পুষ্টি কেন্দ্র, স্ট্রোক পরীক্ষা এবং প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, আবাসিক চিকিৎসকদের জন্য জাতীয় মান-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ক্লিনিকাল অনুশীলন দক্ষতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অনুমোদিত কার্ডিওভাসকুলার জরুরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

থিয়ানচি শহরের হ্যতুং জেলায় প্রায় ৮০ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা হাসপাতালটিতে রয়েছে ১ হাজার ৬শ’ শয্যা, ৪৩টি ক্লিনিকাল ও চিকিৎসা প্রযুক্তি বিভাগ এবং প্রায় ৩ হাজার কর্মী। কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন ৩০৯ জন সহযোগী প্রধান চিকিৎসক ও প্রধান চিকিৎসক এবং ৩৪৭ জন স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রিধারী। এদের মধ্যে আছেন রাষ্ট্রীয় পরিষদ থেকে বিশেষ সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত ১৬ জন বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসাখাতে অসামান্য অবদানের জন্য ‘পার্সোনেল মন্ত্রনালয়’ স্বীকৃত দুজন বিশেষজ্ঞ, মিউনিসিপ্যাল সরকার স্বীকৃত দুইজন বিশেষজ্ঞ, এবং জাতীয় ট্যালেন্ট প্রোগ্রামে তালিকাভুক্ত ১৭জন বিশেষজ্ঞ।

#ভেষজের গুণ

মধুময় যষ্টিমধু

যষ্টিমধু হচ্ছে গ্লাইসাইররিজা গ্লাবরা গাছের শিকড়। এটি মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অনেক দেশে চকোলেট ও মিষ্টিজাতীয় খাবার প্রস্তুতিতে যষ্টিমধু ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে চীনসহ এশিয়ার দেশগুলোতে এটি ঔষধি হিসাবে বেশি ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধে বহুল ব্যবহৃত ভেষজগুলোর একটি যষ্টিমধু। তবে ইউরোপিয়ান মেডিকেল এজেন্সিও তাদের ভেষজ ওষুধে যষ্টিমধুকে যোগ করেছে।

প্রাচীন অ্যাসিরিয়ান, চীনা, মিশরীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে যষ্টিমধু ব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এটি ফুসফুস, লিভার, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন ব্যাধির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। বর্তমানে পরিপাক সমস্যা, রজঃনিবৃত্তিকালীন সমস্যা, কাশি এবং ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাল সংক্রমণের চিকিৎসায় যষ্টিমধু ব্যবহার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর গলাব্যথা প্রতিরোধে কিংবা গলাব্যাথা হয়ে গেলে তা কমানোর ক্ষেত্রে ভাল ফল দেয় যষ্টিমধু। ত্বকের সুস্থতায় ব্যবহৃত কিছু পণ্যেও এটি ব্যবহার করা হয়। হেপাটাইটিস সি বা সোরিয়াসিসের সাময়িক চিকিত্সার জন্যও কোনও কোনও ভেষজ চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা কতটুকু তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলছে। যষ্টিমধুর বেশিরভাগ মিষ্টতা গ্লাইসারাইজিন থেকে আসে। এর মিষ্টতা চিনির থেকে ৩০-৫০ গুণ বেশি। তবে এর মিষ্টি স্বাদ চিনি থেকে আলাদা, তাত্ক্ষণিকভাবে কম লাগে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়।

অনেক ভাল গুণ থাকলেও যষ্টিমধু গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ অধিক পরিমাণে যষ্টিমধু একদিনে খেলে গ্লাইসাররিজিনিক এসিড রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে এবং মাংসপেশী দুর্বল করে দিতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত যষ্টিমধু গ্রহণে হাইপোক্যালেমিয়াও হতে পারে।

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn