বাংলা

দেহঘড়ি পর্ব-০২১

CMGPublished: 2023-06-04 16:11:15
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

রক্তস্বল্পতা সারতে টিসিএম

আপনি কি ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করছেন? আপনার ত্বকের রং কি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে? যদি তাই হয়, তাহলে আপনি সম্ভবত অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। অ্যানিমিয়া এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকা থাকে না। লোহিত রক্তকণিকা শারীরিক সুস্থতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেহের টিস্যুতে অক্সিজেন যোগান দেয়। আয়রনের ঘাটতি, ভিটামিন বি-টুয়েলভের অভাব, ফলিক অ্যাসিডের অভাব কিংবা পারিবারিক ইতিহাস – নানা কারণে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। যে কারণেই হোক না কেন, ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএম অ্যানিমিয়া চিকিৎসায় একটা চমৎকার বিকল্প হতে পারে।

রক্তাল্পতার বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। কিছু জিনগতভাবে জন্মসূত্রে দেহে আসে। গর্ভাবস্থা, আঘাত, মনোনিউক্লিওসিসের মতো অসুস্থতা বা পুষ্টির ঘাটতির মতো কারণেও রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। কোন কোন ধরনের অ্যানিমিয়া লুপাস, ক্রোহনস বা সিলিয়াক রোগের মতো অটোইমিউন ডিজঅর্ডারে সঙ্গে সম্পর্কিত। দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচারের কারণে বা অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের কারণেও রক্তস্বল্পতা হতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ রক্তস্বল্পতা প্রধানত ৫ ধরনের। এগুলো হলো সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, মারাত্মক রক্তস্বল্পতা, আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা, থ্যালাসেমিয়া ও অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া।

রক্তশূন্যতা হলে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলো হলো গায়ের বর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভব করা, মাথা ঘোরা ও মাথাব্যথা। এর অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে পেশীর দূর্বলতা, শ্বাসকষ্ট ও দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, বুক ধড়ফড়ানি ও দ্রুত হৃদস্পন্দন, নিম্ন রক্তচাপ, বিরক্তি, রাগ, হতাশা, বিষণ্নতা ও উদ্বেগের অনুভূতি, এবং মলের গঠনে পরিবর্তন। এছাড়া রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে বরফ খাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা জাগতে পারে।

টিসিএম তত্ত্বে মনে করা হয়, রক্ত তৈরি হয় প্লীহায়, সঞ্চিত হয় যকৃতে এবং নিয়ন্ত্রিত হয় হৃদযন্ত্র দিয়ে। রক্তের একেক ধরনের ঘাটতি একেক অঙ্গ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। যেমন হৃদযন্ত্রে রক্তের ঘাটতির কারণে অস্থিরতা তৈরি হয়, মনোযোগে অসুবিধা হয়, স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা হয় এবং হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়; প্লীহায় রক্তের ঘাটতির কারণে ওজন কমে যায় এবং ক্ষুধামন্দা ও মানসিক অবসাদ দেখা দেয় আর লিভারের রক্তের ঘাটতির ফলে বিরক্তির ভাব জাগে, শরীরে শুষ্কভাব আসে, নখ অতিরিক্ত ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং খিঁচুনি দেখা দেয়।

রক্তস্বল্পতার টিসিএম চিকিৎসা আসলে আকুপাংচার, ভেষজ ও পুষ্টি গ্রহণের একটা সংমিশ্রণ, যা দেহে রক্ত উৎপাদন এবং পরিবহন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে এবং এর মধ্য দিয়ে মাথা ঘোরা, ক্লান্তিবোধ, মাথাব্যথা ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের মতো উপসর্গগুলো দূর হয়। রক্তস্বল্পতা দূর করতে যে আকুপাংচার চিকিত্সা দেওয়া হয়, তার লক্ষ্য থাকে যকৃত, পাকস্থলী ও প্লীহার ‘ছি’কে শক্তিশালী করা।

রক্তস্বল্পতার টিসিএম চিকিৎসায় বেশ কিছু ভেষজ ও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত তাং কুই বা ফিমেল জিংসেং, লিউ চিয়াও চিয়াও বা হরিণের শিংয়ের আঠা, হুয়াং ছি বা অ্যাসট্রাগুলাস, তাং শেং বা রেড সেইজ, চি সুয়ে থাং বা মিলেটিয়া শেকড়, ই চিয়াও বা গাধার চামড়ার আঠা, দু চুং বা ইউকোমিয়া গাছ, হা শৌ উয়ু বা ফ্যালোপিয়া মাল্টিফ্লোরা গাছ, সু দুয়ান বা হিমালয় টিসেল গাছের মূল, এবং হান লিয়ান ছাও বা একলিপ্টা। এসব উপাদান ব্যবহার করে রক্তস্বল্পতার চিকিৎসায় যে ফরমুলেশনগুলো তৈরি করা হয়, সেগুলো জানিয়ে দিচ্ছি এখন।

দাং কুই বু সুয়ে স্যুপ (Dang Gui Bu Xue soup): এ ফরমুলেশনে তাং কুই ও হুয়াং ছি ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ফরমুলেশন হেমাটোপয়েসিসকে উন্নত করে এবং রোগপ্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া দ্রুত করে।

কুই ফি থাং (Gui Pi Tang): সাধারণত হার্ট ও প্লীহার ঘাটতি দূর করতে এটি ব্যবহৃত হয়।

বু চুং ই ছি স্যুপ (Bu Zhong Yi Qi soup): প্রধানত ‘ছি’কে শক্তিশালী করতে এ ফরমুলেশন ব্যবহৃত হয়। যেহেতু ছি ও রক্ত একই উত্স থেকে আসে, তাই এই সূত্রটি ‘ছি’কে শক্তিশালী করার মাধ্যমে আসলে রক্তকে পুষ্ট করে।

সি উয়ু থাং (Si Wu Tang): এ ফরমুলেশন ব্যবহৃত হয় মূলত রক্তের পুষ্টি বাড়াতে।

বা চান স্যুপ (Ba Zhen soup): ‘ছি’কে শক্তিশালী করতে এবং রক্তকে পুষ্ট করতে এটি ব্যবহৃত হয়।

উয়ু চি বাই ফেং ওয়ান (Wu Ji Bai Feng Wan): ‘ছি’ ও রক্তকে পুষ্ট করতে, ঋতুস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে, সুস্থতার উন্নতি করতে এবং প্রসব-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে ব্যবহৃত হয় এ ফরমুলেশন।

শাং ইয়ু থাং (Sheng Yu Tang): লিভার ও হার্টের ঘাটতি দূর করতে ব্যবহৃত হয় এ ভেষজ।

#চিকিৎসার_খোঁজ

হারবিন হারবিন মেডিকেল ইউনিভার্সিটি’র ক্যান্সার হাসপাতাল

হারবিন মেডিকেল ইউনিভার্সিটি’র ক্যান্সার হাসপাতাল এ চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত তৃতীয় হাসপাতাল। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি হেইলুংচিয়াং প্রদেশের শীর্ষ বিশেষায়িত হাসপাতাল, যেটি ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা এবং ক্যান্সার-বিষয়ক শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিবেদিত। গোটা দেশের মধ্যেও এটি সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বিস্তৃত পরিসরে সেবা প্রদানকারী টিউমার ও ক্যান্সার চিকিৎসা-কেন্দ্র।

প্রায় আড়াই লাখ বর্গমিটার এলাকার ওপর প্রতিষ্ঠিত সাড়ে ৩ হাজার শয্যাবিশিষ্ট এ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর ৭ লাখ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার রোগীকে ভর্তি করে সেবা দেওয়া। এছাড়া এখানে বছরে শল্যচিকিৎসা দেওয়া হয় ৩৬ হাজার রোগীকে।

এ ক্যান্সার হাসপাতাল হারবিন মেডিকেল ইউনিভার্সিটির তৃতীয় হাসপাতাল নামেও পরিচিত। এখানে রয়েছে ৫০টি ক্লিনিকাল বিভাগ, ১৫টি চিকিৎসা প্রযুক্তি বিভাগ, ১২টি শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ এবং ৬টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ হাসপাতালে কর্মরত ২ হাজার ৫৩৬ জন কর্মী, যাদের মধ্যে ১ জন বিদেশি স্কলার, ১জন জাতীয় মিলিয়ন ট্যালেন্ট প্রকল্পে নির্বাচিত স্কলার, ১জন জাতীয় দশ হাজার প্রতিভা কর্মসূচির শীর্ষস্থানীয় তরুণ প্রতিভা, ৫জন রাষ্ট্রীয় পরিষদের ভাতাপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ, ৩জন প্রাদেশিক সরকারের ভাতাপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ, ৮৫জন ডক্টরাল সুপারভাইজার এবং ২৬৫জন স্নাতকোত্তর সুপারভাইজার।

চীন-রাশিয়া মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অ্যালায়েন্সের উপর ভিত্তি করে, এ হাসপাতালটি দু’দেশের যৌথ চিকিৎসা গবেষণাকে শক্তিশালী করেছে। এ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের এমডি অ্যান্ডারসন ক্যান্সার সেন্টার, পিটসবার্গ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিন এবং সিয়াটলের সুইডিশ মেডিকেল সেন্টারের টিউমার ইনস্টিটিউটের সঙ্গে।

#ভেষজের গুণ

গরীবের জিনসেং কোডোনোপসিস শিকড়

কোডোনোপসিস গাছের শিকড়ে রয়েছে নানা স্বাস্থ্যগত উপকারিতা। এটি দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে, স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং অ্যাডাপটোজেন হিসাবে কাজ করে। অ্যাডাপটোজেনের কাজ হলো মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা। কোডোনোপসিস বেলফুল পরিবারের সদস্য। ভেষজ ওষুধের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ অ্যাডাপ্টোজেন হলো জিনসেং ও কোডোনোপসিস শিকড়। এ কারণে কোডোনোপসিস শিকড়কে অনেকে গরীবের জিনসেং বলে বিবেচনা করে।

অনেকে বিশ্বাস করে, এই ঔষধি শরীরের প্রদাহ কমাতে পারে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইমিউন সিস্টেম-কোষে প্রদাহ হলে কোডোনোপসিস দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং প্রদাহ উপশমে সাহায্য করে। এই শিকড়ের আরেকটি উপকারিতা হলো জিঙ্কো বিলোবার সংমিশ্রণে এটা গ্রহণ করলে এটি স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং কোনও কিছু শেখার প্রক্রিয়া দ্রুত করে। কোনও কোনও গবেষণায় দেখা গেছে, জিংকো ও কোডোনোপসিস একসাথে গ্রহণ করলে স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ করার ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা প্লাসিবোর চেয়ে বেশি হয়।

ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরকে সমর্থন করা এবং ডায়াবেটিসের জটিলতা কমানোর ক্ষেত্রে কোডোনোপসিস দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহৃত অন্যতম প্রধান চীনা ভেষজ। এছাড়া এ ভেষজটি পুরো শরীরে শক্তি জোগাতে কাজ করে এবং এর বেশিরভাগ কাজ হয় ফুসফুস ও প্লীহাকে কেন্দ্র করে। হাঁপানি উপশমেও কোডোনোপসিসকে উপকারী বলে মনে করা হয়। কোনও কোনও গবেষণায় দেখা গেছে, কোডোনোপসিস শিকড় রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া এ ভেষজ মানসিক চাপের বিভিন্ন উপসর্গ যেমন পেশী টান, ক্লান্তি, মাথাব্যথা ও উচ্চ রক্তচাপ উপশমে সহায়তা করে, ক্ষুধামন্দা দূর করে এবং প্লীহার কার্যকারিতা বাড়ায়।

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনা

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn